শুধুমাত্র মওলানা শফীই নয়, সমগ্র সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী-পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাই নারীকে যৌনবস্তু বানিয়েছে

জুলাই ’১৩-এর শেষ দিকে হেফাজতের আমির মওলানা শফী’র একটি ভিডিও চিত্র বিটিভিতে ফলাও করে কয়েকদিন ধরে প্রচার করা হয়, যাতে তাকে দেখা যায় তেঁতুলের সাথে নারীদের তুলনা করে চরম নারী বিরোধী কথাবার্তা বলতে। প্রধানমন্ত্রিসহ আওয়ামী-মহাজোট ঘরানার রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী, বুদ্ধিজীবী এবং এনজিও’রা এ নিয়ে মহা হৈচৈ ফেলে দেয়। দেখাতে চায় যে, তারা কতইনা নারী মুক্তির পক্ষে আর যে মি.শফি ও হেফাজত নারীর এত বড় শত্রু তাকে কিনা বিএনপি সমর্থন দিচ্ছে। এটা যে আওয়ামী জোটের আরেকটি বিএনপি-বিরোধী নির্বাচনী প্রচার-কৌশল তা খুব কষ্ট করে বুঝতে হয় না।
মি. শফীর ভিডিও চিত্রের বক্তব্যটি প্রগতিশীল কোন ব্যক্তিই সমর্থন করবে না। কারণ এই বক্তব্যটি মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক/পুরুষতান্ত্রিক নগ্ন প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রগতিবিরোধী বক্তব্য তাতে সন্দেহ নেই। এতে নারীকে শুধু তেঁতুলই বলা হয়নি, যাকে দেখলে নাকি পুরুষমাত্রেরই লালা ঝরে, উপরন্তু তাতে বলা হয়েছে নারীরা ক্লাস ফোর/ফাইভের বেশি লেখাপড়ার দরকার নেই, কারণ তার মূল দায়িত্ব হলো স্বামীর সম্পদাদি দেখে শুনে রাখা। নারী গার্মেন্টস শ্রমিকদের কাজ করা উচিত নয়, কারণ, তারা রাত-বিরেতে বাইরে থেকে অসামাজিক কাজ করে, নিজে নিজে বিয়ে করে। ইত্যাদি চরম প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্য এই মওলানা প্রদান করেছে অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ ভাষায় ও নারীর প্রতি জঘন্য দৃষ্টির দ্বারা।
বাংলাদেশে বিগত ৪২ বছর ধরে আমরা দেখে আসছি হাজার হাজার ওয়াজ-মাহফিলে ধর্মান্ধ মৌলভিগণ নারী বিরোধী এইসব নসিয়ত করে চলেছেন। এমনকি এইসব ওয়াজ ক্যাসেট করে শহরে নগরে ও গ্রামাঞ্চলের পথে ঘাটে, ঘরে ঘরে বাজানো হচ্ছে। কিন্তু কখনো আওয়ামী লীগ, তার নেতা বা তাদের বুদ্ধিজীবীদেরকে এসব প্রশ্নে কথা বলতে শোনা যায়নি। তারা এসব ওয়াজকে নিষিদ্ধ করেনি। বরং তাদের স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা এ জাতীয় ওয়াজ সম্মেলনের ব্যবস্থা প্রায়ই করে থাকে বিভিন্ন এলাকায়।
অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ নারী স্বাধীনতার নামে নারীদেরকে নগ্ন অর্ধনগ্নভাবে তেঁতুল হিসেবেই উপস্থাপন করছে। বোম্বাইয়া সিনেমায় আর দেশি-বিদেশি সব বিজ্ঞাপনে এসব তেঁতুলকেই দেখা যায়। কিন্তু এসবও সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী সংস্কৃতির কাছে নস্যিমাত্র। কারণ, তারা এখন সোজাসুজি কাপড়-চোপড় সম্পূর্ণ ফেলে পর্ণো ছবি চালাচ্ছে, যা ইদানীং আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মকে ব্যাপকভাবেই গ্রাস করেছে। কিন্তু শেখ হাসিনার বা আওয়ামী লীগের আমলে এসব তেঁতুল বিক্রি বেড়েছে বৈ কমেনি। হুজুররা নারীকে বোরখা পরিয়ে রাখতে চায়, কারও যাতে লালা না ঝরে; আর চলমান ব্যবস্থা নারীকে খুলেই রাখতে চায় যাতে সহজে মানুষের লালা ঝরে এবং তাদের বাণিজ্য/মুনাফা ভাল হয়। কারণ, নারী তাদের কাছে পণ্য বৈ আর কিছু নয়।
আওয়ামী জোট সরকার ও তাদের বুদ্ধিজীবীরা জোর গলায় প্রচার চালিয়েছে শফী হুজুরের বয়ান ইসলামের বিকৃতি; বিপরীতে তারই নাকি ইসলামের প্রকৃত ধারক-বাহক। আসলে প্রকৃত ইসলাম ও ধর্মের ধারক-বাহক যে কে সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে; তবে সে বিতর্ক যে শেষ হবার নয় তা বলাই বাহুল্য। তবে ধর্মীয় জ্ঞান শফী মওলানাদের থেকে হাসিনা আর ইনুর বেশি রয়েছে সেটা ভাবা ভুল হবে। ধর্মের ব্যাখ্যায় ঢোকার এই মূর্খতা আর বদমায়েশী মধ্যযুগীয় মূল্যবোধগুলোকেই শুধু শক্তিশালী করতে পারে। কোন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বা প্রগতিশীল চেতনা নয়। সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদীরা, আমাদের দেশে আমলা-মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ারা নিজেরা নারীকে নিয়ে ব্যবসা করে বলে তারা সামন্ততান্ত্রিক মধ্যযুগীয় এই মওলানাদের প্রতিক্রিয়াশীলতাকে সংগ্রাম করতে সক্ষম নয়। এরা পদে পদে ধর্মীয় মৌলবাদীদের সাথে আপোষ করে, জনগণকে প্রতারণা করে। তারা সুদীর্ঘদিন ধরে বুর্জোয়া নারীবাদের প্রতিনিধি তসলিমা নাসরিনকে দেশের বাইরে রেখে দিয়েছে; তাকে দেশে আসতে দিচ্ছে না। কেন? শুধু এইসব প্রতিক্রিয়াশীল মধ্যযুগীয় ধর্মীয় রাজনীতি ও ধর্মীয় নেতাদের চাপে। আর এরাই কিনা দাবি করছে তারা নারীদের মুক্তির সপক্ষের শক্তি।
বাংলাদেশ-ভারত, এমনকি সাম্রাজ্যবাদী দেশে নারীরা ধর্ষণ-গণধর্ষণের শিকার হচ্ছেন হরহামেশাই। সরকার সর্বত্র সহশিক্ষার ব্যবস্থা না করে নারীদের জন্য পৃথক মহিলা স্কুল-কলেজ করছে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রি নারীদের ‘শালীন’ পোশাক পরার নসিহত করেছে। এগুলো কি চেতনা ধারণ করে? প্রতি পরিবারের অভিভাবকগণ তরুণ মেয়েদেরকে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় লালন-পালন করতে বাধ্য হচ্ছেন এর কারণ কি? সিনেমা, নাটক, বিজ্ঞাপন, ব্লু ফিল্ম, ফ্যাশনশো, সুন্দরী প্রতিযোগিতা ইত্যাদি ইত্যাদির মাধ্যমে তারাও নারীদেরকে তেঁতুল হিসেবেই উপস্থাপন করছে।
’৯৭ সালে প্রগতিশীল নারী সংগঠনগুলোর চাপে আওয়ামী লীগ সরকার নারী নীতি ঘোষণা করেছিল। এই নীতিমালায় ‘উপার্জন, উত্তরাধিকার সম্পদ, ভূমি ইত্যাদি প্রশ্নে নারীর পূর্ণ ও সমান সুযোগ’ প্রদানের বিষয় উল্লেখ ছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীন থাকা সত্বেও হাসিনা সরকার এই নীতিমালা তখন পাশ করেনি, মৌলবাদীদের চাপের মুখে পিছিয়ে যায়। বর্তমানে মহাজোট সরকার যে নীতিমালা ঘোষণা করেছে তাতে উত্তরাধিকার সূত্রে জমি-সম্পদে নারীর সমঅধিকারের প্রশ্ন চতুরতার সাথে এড়িয়ে গেছে। তা সত্বেও ধর্মীয় মৌলবাদীরা জেহাদ ঘোষণা করলে হাসিনা সরকার নতজানু হয়ে বলেছে আমরা কোরান-সুন্নার বিরোধী নই। মহিলা ও শিশু বিষয়ক তৎকালীন প্রতিমন্ত্রি ড. শিরিন সারমিন চৌধুরী বলেছিলেন “নতুন নারী উন্নয়ন নীতির কোথাও উত্তারাধিকার সূত্রে সম্পদে নারীর সমঅধিকারের কথা নেই”। তিনি আরো বলেছেন, “মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী নারীর উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তির বন্টন যেভাবে হয়েছে সেভাবেই হবে।”
এ ভাবে মহাজোট সরকার ধর্মীয় মৌলবাদীদের কাছে নতি স্বীকার করে মধ্যযুগীয় নারী বিরোধী আইন, মূল্যবোধ, তথা পুরুষতন্ত্রকে বহাল তবিয়তে রেখে দিয়েছে।
শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়া নারী হলেও তারা নারীর শত্রুদেরই প্রতিনিধিত্ব করে। নারীর শত্রুদের পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থা উচ্ছেদ ব্যতীত নারীর প্রতি এই জঘন্য দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হতে পারে না। শুধুমাত্র কমিউনিজমের আদর্শে একটি পূর্ণাঙ্গ বিপ্লবই পারবে নারীকে পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করতে। যে সমাজ নারীকে মানুষ হিসেবে পরিপূর্ণ সম্মান ও মর্যাদা দেবে। পুরুষও হয়ে উঠবে প্রকৃত মানুষ।

About andolonpotrika

আন্দোলন বুলেটিনটি হলো বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন ও বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের একটি অনিয়মিত মুখপত্র
This entry was posted in আন্দোলন 15. Bookmark the permalink.

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s