জাতীয় স্বার্থ বিরোধী টিক্ফা চুক্তির বিরোধিতা করুন

সম্প্রতি বাংলাদেশের সরকার মন্ত্রি পরিষদের বৈঠকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বানিজ্য বিষয়ক দ্বিপাক্ষিক টিক্ফা চুক্তির নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। এখন শুধুই পরে আনুষ্ঠানিক চুক্তি বাকি। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মোজেনা আশাবাদ ব্যক্ত করেছে, ওয়াশিংটনে শিগগিরই বাংলাদেশের বানিজ্য মন্ত্রি গোলাম কাদেরের উপস্থিতিতে চুক্তিটি স্বাক্ষর হবে।
প্রায় সব মহলের বিরোধিতা সত্ত্বেও সরকারের মন্ত্রি পরিষদ এই চুক্তির অনুমোদন দিয়েছে। এখন চূড়ান্ত স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে। কি আছে এই চুক্তিতে? সরকারের শেষ সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করতে উঠেপড়ে লেগেছে।
আমরা সবাই জানি কিছুদিন পূর্বে মার্কিন সরকার বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল করেছে। তারা রানা প্লাজার ধ্বসের কারণকে মূলতঃ অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু মার্কিন রাষ্ট্রদূত মোজেনা গত ২৮ জুলাই টিকফা চুক্তি স্বারের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানিয়ে বলে টিকফা চুক্তি সই না করলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য ‘শুল্কমুক্ত’ প্রবেশাধিকার পাবে না। যুক্তরাষ্ট্রে প্রধানতম বাংলাদেশী পণ্য হলো গার্মেন্টস সামগ্রী। বাংলাদেশের গার্মেন্ট পণ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা অর্থাৎ ‘শুল্কমুক্ত’ সুবিধার বাইরেই রেখেছে। মার্কিনীরা বাংলাদেশের যে সব পণ্যে জিএসপি সুবিধা দেয়, তা বলতে গেলে সে দেশে রপ্তানি করা হয় না বললেই চলে। সেই অর্থে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জিএসপি অর্থাৎ শুল্কমুক্ত সুবিধা মূলত পায় না। বরং যুক্তরাষ্ট্র ৭৫ কোটি ডলার শুল্ক বাংলাদেশ থেকে পায়। দেশটিতে বাংলাদেশের মোট রফতানি প্রায় ৪৮০ কোটি ডলারের। এর মধ্যে মাত্র ০.৫ শতাংশ পণ্য জিএসপি সুবিধা পায়। এই কারণে বাংলাদেশে পোশাক রপ্তানিকারকরা দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা পাওয়ার জন্য দেনদরবার করেও আসছে।
এখন সরকার এবং মার্কিন লবির বিভিন্ন মহল যুক্তি দিচ্ছে টিকফা চুক্তি স্বার করলে মার্কিনীরা জিএসপি সুবিধা আবার ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু বিজিএমইএ-ই গুমর ফাঁস করে দিয়েছে। তারা বলেছে, বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পোশাক খাত মার্কিন সরকারের কাছ থেকে কোন শুল্কমুক্ত সুবিধাই পায় না। তাই মার্কিনীদের জিএসপি সুবিধা বাতিলে বাংলাদেশের জন্য কোন সমস্যাই হবেনা। এখন বুঝুন সরকারের মার্কিন প্রীতির নমুনা।
মার্কিনীরা বলছে এ চুক্তি স্বারের পর য্ক্তুরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে বাড়বে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিও। এই যে বিনিয়োগের কথা বলা হচ্ছে তাতে পণ্য উৎপাদন বাড়বে না। বরং টিকফা চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের সেবা খাতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। সেবা খাতের নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে মার্কিনীদের হাতে। বিশেষতঃ জ্বালানী, গ্যাস, বিদ্যুৎ, সমুদ্র বন্দর, টেলিযোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ইত্যাদি মার্কিন পুঁজিপতিদের কাছে উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। মার্কিনীদের অনুমতি ছাড়া অন্য কেউ সেবা খাতে বিনিয়োগ করতে পারবে না। এই চুক্তি হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিক কোম্পানীর জন্য বাংলাদেশের সেবা খাতকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। বিশেষত জ্বালানী খাত এবং সমুদ্র বন্দরের উপর তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা হবে।
এই চুক্তিতে প্যাটেন্ট সংক্রান্ত যে ধারা আছে তা বাংলাদেশের সদ্য বিকশিত ঔষধ শিল্পের উপর আঘাত হানবে। বাংলাদেশের ঔষধ শিল্প বর্তমানে দেশের ৯৫% চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করছে। এই চুক্তিতে প্যাটেন্ট সংক্রান্ত ধারার কারণে দেশের মাঝারী এবং ছোট ঔষধ শিল্প বড় বড় বহুজাতিক ঔষধ কোম্পানীর কাছে প্রতিযোগিতায় মার খাবে।
প্যাটেন্ট সংক্রান্ত ধারার কারণে কৃষির উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। সাম্রাজ্যবাদের চাপে কৃষিতে ৫%-এর বেশী ভর্তুকী দিতে পারছে না সরকার। ফলে বাংলাদেশের কৃষিজ পণ্যের দাম ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র নিজেই কৃষিতে ১৯%-এর বেশী ভর্তুকী দিয়ে তাদের কৃষি ব্যবস্থাকে সুরা দিচ্ছে। এই প্যাটেন্টের ফলে বাংলাদেশের বীজের উপর কৃষকদের অধিকার থাকবে না। মার্কিনসহ বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর লক্ষ হলো বীজের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। বীজ বিক্রি করে তারা ৪/৫ গুণ মুনাফা করবে। তারা আমাদের দেশের জীব-বৈচিত্র ধ্বংস করে দেবে, দেশের কৃষির উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে। ইতিমধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার ১৫০-২০০ উদ্ভিদের উপর মার্কিনসহ বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানী প্যাটেন্ট অধিকার লাভ করেছে। নিম, উলট কমল, বহেরা, থানকুনিসহ বিভিন্ন ঔষধি উদ্ভিদের উপর তারা প্যাটেন্ট দাবী করছে। যে উদ্ভিদগুলো এ দেশে হাজার হাজার বছর ধরেই উৎপন্ন হয়ে আসছে।
আওয়ামী মহাজোট সরকার তাদের আগামী নির্বাচনে প্রভু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কৃপা লাভের জন্য তাদের চাপের মুখে নতি স্বীকার করে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে তড়িগড়ি করে এই টিকফা চুক্তি করছে। আরেক দালাল গোষ্ঠি বিএনপি জোট এ প্রশ্নে টু-শব্দটি পর্যন্ত করছে না। তাই, বিপ্লবী, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে শ্রমিক, কৃষকসহ সর্বস্তরের জনগণকে এ সম্পর্কে সচেতন করে এই চুক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। মার্কিনসহ সকল সাম্রাজ্যবাদ, দালাল বুর্জোয়া শাসকশ্রেণী উচ্ছেদের বিপ্লবী সংগ্রামকে বেগবান করেই জাতীয় স্বার্থ বিরোধী চুক্তিকে রোধ করা সম্ভব।

About andolonpotrika

আন্দোলন বুলেটিনটি হলো বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন ও বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের একটি অনিয়মিত মুখপত্র
This entry was posted in আন্দোলন 15. Bookmark the permalink.

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s