গত ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৩-এ ঢাকার সোরওয়ার্দী উদ্যানে নৌ-মন্ত্রি শাহজাহান খানের নেতৃত্বে গার্মেন্ট শ্রমিকদের এক সমাবেশ হয়ে গেল। গার্মেন্ট শ্রমিকদের ৫২টি সংগঠনের মাঝে ২০টির বেশি সংগঠন এই সমাবেশে যোগ দিয়েছে বলে দাবী করা হয়েছে। মহাজোট সরকারের শরীক তথাকথিত বাম পার্টিগুলোর শ্রমিক সংগঠন এবং এনজিও দ্বারা গঠিত শ্রমিক সংগঠনগুলো এ সমাবেশে যোগ দিয়েছে। আর এই সংগঠনগুলোর সমন্বয় পরিষদের আহবায়ক বানানো হয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রি শাহজাহান খানকে। এতদিন মাদারীপুর জেলার সন্ত্রাসী গডফাদার, পরিবহন মালিক এই বুর্জোয়া নেতা ছিলেন পরিবহন ‘শ্রমিক নেতা’। পরিবহন শ্রমিক নেতা হয়ে শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনকে বুর্জোয়া রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার, চাঁদাবাজী আর সন্ত্রাসসহ শ্রমিক শ্রেণীর একটি অংশকে অধঃপতিত ও কলুষিত করা এবং নিজে বিপুল অর্থ বিত্ত হাতিয়ে নেওয়ার কাজে সে বিশেষ সফলতা দেখিয়েছিল। এবার নৌ মন্ত্রী হয়ে নৌ-শ্রমিকদের উপরেও সে ছড়ি ঘুরিয়েছে। আর এখন রাতারাতি গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা বনে গেছে। এর রহস্য কি?
বহু শ্রমিকের রক্তের বিনিময়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার বাংলাদেশের গার্মেন্ট কারখানাগুলোতে মূলত নিষিদ্ধ। মালিকরা শ্রমিকদের কেউ ট্রেড ইউনিয়নে যুক্ত হওয়ার বিষয় জানতে পারলে তাদের চাকরী থেকে ছাঁটাই করে। তা সত্বেও বাম সংগঠনগুলো বা এনজিওগুলো গার্মেন্ট শ্রমিকদের কিছু কিছু ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুলেছে। সাভারে রানা প্লাজা ধসে শত শত শ্রমিক নিহত, আহত ও নিখোঁজ হওয়ায় দেশে বিদেশে গার্মেন্টসগুলোতে ট্রেড ইউনিয়নসহ বিভিন্ন শ্রমিক অধিকারের অভাব নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠে। শ্রমিকরাও ৮ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরীর দাবীতে প্রায় প্রতিদিন বিক্ষোভ করছেন। মালিকরা মাত্র ৬০০ টাকা বাড়িয়ে ৩৬০০ টাকা ন্যূনতম মজুরী দেয়ার প্রস্তাব করেছে। এর প্রতিবাদে শ্রমিক শ্রেণী বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। এই বিক্ষোভকে হাসিনা সরকার পুলিশ বাহিনী দিয়ে নির্মমভাবে দমন করছে।
শ্রমিক আন্দোলনের এই পরিস্থিতি মহাজোট সরকার ও আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের সামনে বিপদে ফেলেছে। ভোটের জন্য এই শ্রমিকদের পক্ষো রাখা দরকার। তার চেয়ে বেশি দরকার গার্মেন্ট মালিকদের সমর্থন আর টাকা। কার্যত আওয়ামী লীগের নেতাদের অর্ধেক নিজেরাই গার্মেন্ট মালিক। এই অবস্থায় শ্রমিক-মালিক উভয়কে হাতে রাখার এক সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে চক্রান্তমূলকভাবে নৌ-পরিবহন মন্ত্রি শাহজাহান খানকে দিয়ে ২১ সেপ্টেম্বর গার্মেন্ট শ্রমিকদের মহাসমাবেশ ডাকে।
শাহজাহান খান নিজে হচ্ছে বুর্জোয়া। পরিবহন মালিক। রাজনৈতিকভাবে সে বুর্জোয়া পার্টির লোক। শ্রমিক নেতার নামে সে হলো মালিক শ্রেণীর প্রতিনিধি। সুতরাং সে হলো ছাগলের ছাল গায়ে নেকড়ে। গত ৫ বছর ধরে সে আওয়ামী মহাজোট সরকারের মন্ত্রি। যে সরকারের মন্ত্রিসভা ২২ এপ্রিল, ২০১৩ “শ্রম আইন ২০০৬”-এর সংশোধনী প্রস্তাব নীতিগতভাবে গ্রহণ করেছে, যা শ্রমিক স্বার্থ এবং শ্রমিক সংগঠন বিরোধী। যে শ্রম আইন বাতিলের দাবী বাম ধারার শ্রমিক সংগঠনগুলো করে আসছে। যে সরকার শ্রমিক দমনের জন্য ইন্ডাষ্ট্রিয়াল পুলিশ গঠন করেছে। যে সরকার শ্রমিকদের প্রতিটি ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে পুলিশ-র্যাব লেলিয়ে দিয়ে নির্মমভাবে দমন করছে। যে সরকার শ্রমিকদের প্রতিটি আন্দোলনকে বহিরাগত ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করে মালিকদের স্বার্থ রক্ষা করছে। সে সরকারের মন্ত্রি আজ গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা সেজে শ্রমিকদের সমাবেশ ডেকে এক নতুন ষড়যন্ত্রের শুরু করেছে।
এই সমাবেশের মধ্য দিয়ে মহাজোট সরকার ও আওয়ামী লীগ তাদের দুটি লক্ষ্য হাসিল করতে চাচ্ছে। এক) সমাবেশে শ্রমিকদের দাবির কিছু হাওয়াই কথা বলে এবং হাসিনাকে দিয়ে শ্রমিক মজুরীর কিছু বৃদ্ধি ঘোষণা করে আসন্ন নির্বাচনে তাদের পক্ষে ৪০ লক্ষ গার্মেন্ট শ্রমিকদের সমর্থন টেনে আনা; দুই) দুর্বার গার্মেন্ট শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দখল করে তাকে পথভ্রষ্ট করা, তাকে বিভ্রান্ত করা, তাকে আপোষের পথে ঠেলে দেয়া, মালিকদের কাছে গ্রহণীয় কিছূ খুদ-কুড়া মজুরী বৃদ্ধি শ্রমিকদের দিয়ে গেলানো। যা বুর্জোয়া দলগুলো সর্বদাই এবং সব শ্রমিক সংগঠনের ক্ষেত্রে করে থাকে। এই শ্রমিক নেতা সোরওয়ার্দী উদ্যানে হেফাজতের তেঁতুল তত্ত্বের বিরোধিতা করার অজুহাতে আওয়ামী রাজনীতি শ্রমিকদের মাথায় চালান করতে চেয়েছে। সে মন্ত্রিসভায় গৃহীত শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী আইনের বিরোধিতা করেনি। এমনকি জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলনকে দমনের হুমকিও প্রদর্শন করছে।
কিন্তু এই সমাবেশ তাদের জন্য কিছুটা বুমেরাং হয়ে গেছে। শ্রমিক শ্রেণী তাদের ৮ হাজার টাকার দাবি আরো জোরে শোরে তুলেছে। তাদেরকে বাগে আনা সম্ভব হয়নি বুর্জোয়া ও তথাকথিত বাম নেতাদের পক্ষে। ফলে গার্মেন্টস মালিকরা পর্যন্ত খানের উপর ক্ষেপে গেছে। মালিকদের ধমক খেয়ে এই ভন্ড শ্রমিক দরদী খান এখন সরাসরি শ্রমিকদের আন্দোলনের বিরুদ্ধাচরণ করছে। যারা আন্দোলন করবে তারা সন্ত্রাসী এমন হুমকিও দিয়েছে।
তাই, শ্রমিকশ্রেণীকে শ্রেণী সচেতন হবার তাগিদ অনুভব করতে হবে। কোন বুর্জোয়া পার্টি, সংগঠন ও ব্যক্তির পক্ষে শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব নয়। বুর্জোয়া পার্টির নেতা-নেত্রীরা শ্রমিক শ্রেণীর নেতা হতে পারে না। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামাতসহ অন্যান্য বুর্জোয়া দলগুলো শ্রমিক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে না। তারা মালিক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে। প্রতিটি বুর্জোয়া সরকারই দমন নিপীড়ন চালায়। শ্রমিকদের জীবন-সংগ্রাম দিয়েই তা উপলব্ধি করা সম্ভব। শ্রমিক শ্রেণীকে শাহজাহান খানদের মত বুর্জোয়া নেতাদের প্রত্যাখ্যান করতে হবে। শ্রমিক শ্রেণীর রাজনীতির ভিত্তিতে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করতে হবে। তা না হলে তাদের রক্ত ও ঘাম ঝরানো আন্দোলন ব্যর্থ হবে, তাদের মাঝে মালিকের ভাড়াটিয়ারা আসন গাড়বে, তাদের মুক্তি হবে সূদুর পরাহত।
-
সাম্প্রতিক লেখা
সংগ্রহ
বিষয়
-
Join 6 other subscribers
Blogroll
Top Clicks
- None