গার্মেন্ট শ্রমিকরা বর্তমানে ন্যূনতম মজুরী ৮,০০০ টাকার দাবীতে আন্দোলন করছেন। বুর্জোয়া শাসকদের স্বীকৃত দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী এই শ্রমিকদের জীবন-যাপন যে মধ্যযুগীয় দাসদের হার মানিয়েছে তা দেশের বিপ্লবী, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল পার্টি, সংগঠন, শক্তি, ব্যক্তি, এমনকি বুর্জোয়া মানবাধিকারবাদী এবং সাংবাদিকগণও হরহামেশাই লেখালেখি করে আসছেন। রানা প্লাজা ধসে ১১শ’র অধিক শ্রমিকের মৃত্যু এবং শত শত শ্রমিকের নিখোঁজের ঘটনায় গার্মেন্টের পরিবেশ নিয়ে দেশে-বিদেশে সমালোচনার ঝড় উঠলে শেখ হাসিনা সরকার দ্রুত মজুরী বোর্ড গঠন করে। এবং তিন মাসের মধ্যে নতুন মজুরী ঘোষণা করা হবে বলে প্রচার দেয়। কিন্তু প্রায় পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও শ্রমিকদের দাবী অনুযায়ী ন্যূনতম মজুরী আলোর মুখ এখনও দেখেনি। মধ্যে দুটো ঈদ পড়ে যাওয়ার কারণে মালিকদেরকে বর্ধিত ঈদ বোনাস থেকে বাঁচানোর জন্যও-যে সরকার এই গড়িমসি করেছে তাও বলাই বাহুল্য। বহু টালবাহানা করে অবশেষে সেপ্টেম্বর মাসে গার্মেন্ট মালিকরা বলেছে আগের মজুরীর সাথে আর মাত্র ৬০০/- টাকা যোগ করে তারা ন্যূনতম মজুরী দেবে ৩,৬০০ টাকা। মালিক শ্রেণীর এই সরকার ২০১০ সালে গার্মেন্ট শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরী ৫ থেকে ৭ হাজার টাকার দাবীর প্রেক্ষিতে করেছিল মাত্র ৩ হাজার টাকা। বিগত তিন বছরে দ্রব্যমূল্য, বাড়ী ভাড়া, পরিবহন ভাড়া বেড়েছে কয়েক গুণ। কিন্তু শ্রমিকরা মরিয়া আন্দোলনে নামার আগ পর্যন্ত সরকার তাদের মজুরী বৃদ্ধির বিষয়ে টু শব্দটি করেনি। অন্যদিকে তারা রাস্তার পাশে বিলবোর্ড টানিয়ে শ্রমিকদের জীবন-মান উন্নয়নের মিথ্যা বাগাড়ম্বর করছে। বর্তমানেও শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরী বৃদ্ধির ন্যায্য আন্দোলনকে সরকার র্যাব-পুলিশ লেলিয়ে নির্মমভাবে দমন করছে।
শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরী কি হওয়া উচিত? মালিক পক্ষ শ্রমিকদের দাবী মানতে চাচ্ছে না। তারা বলছে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা কোন মূল্য বৃদ্ধি করছে না। উৎপাদন খরচ বেড়েছে। তাই তারা মজুরী ৬০০ টাকার বেশী বৃদ্ধি করতে পারবে না। এর বেশী করলে তাদের লস হবে। কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে। তাতে দেশের ক্ষতি হবে, শ্রমিকরাই বেকার হবে, তাই শ্রমিকদের আন্দোলন করা উচিত নয় ইত্যাদি। এসব কথা যে অতি মুনাফালোভী গার্মেন্টস মালিকদের কুযুক্তি সেটা এই সরল তথ্য থেকেই প্রমাণিত হবে যে, গার্মেন্ট ব্যবসা করে এদেশে কেউ লস খায়নি। বরং একটি গার্মেন্ট দিয়ে শুরু করে মাত্র কয়েক বছরেই দুই/চার/দশটি গার্মেন্টেস কোম্পানীর মালিক হয়ে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে এই মালিকরা। দেশের আর দশটি শ্রম-ক্ষেত্রে, যেখানে উৎপাদনশীলতা অনেক কম সেগুলোতেও শ্রমিকের মজুরীর সাথে তুলনা করলে এ সত্যটি প্রমাণিত হবে। বর্তমান সরকার, আগের সব সরকারগুলোর মতই, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মালিকদের এইসব কুযুক্তিকেই তুলে ধরে শ্রমিকদের ন্যায্য আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার জন্য।
অবশ্য শ্রমিক আন্দোলনের ফলে এখন মালিকরা বলছে মজুরী বোর্ড যে সিদ্ধান্ত দিবে তারা তা মেনে নিবে। সরকার বলছে নভেম্বরে তারা নিুতম মজুরী ঘোষণা করবে। মালিকরা জানে যে, সরকার তাদেরই স্বার্থরাকারী। আর মজুরী বোর্ডে শ্রমিক প্রতিনিধি হিসেবে যারা রয়েছে সেই শাহজাহান খানের মত বুর্জোয়া শ্রমিক নেতারা শ্রমিক আন্দোলনে বুর্জোয়াদেরই প্রতিনিধিত্ব করে। তারা শ্রমিকদেরকে সরকারী সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে ঠান্ডা করবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তাই, মালিকরা সরকারের উপর আস্থাশীল যে, সরকার মালিকদের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেবে না।
* অন্যান্য পণ্যের মত শ্রম শক্তিও একটি পণ্য। শ্রম শক্তির মূল্য শ্রম শক্তির উৎপাদনের ব্যয়ের উপর নির্ভরশীল। শ্রম শক্তি উৎপাদনের ব্যয় কিভাবে নির্ধারণ করা হয়? মজুরকে মজুর হিসেবে বাঁচিয়ে রাখা এবং মজুরদের যোগান অব্যাহত রাখার জন্য যে খরচ হয় তা হলো শ্রম শক্তির উৎপাদন ব্যয়। তাই মজুরের শ্রমের দাম তার জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় উপকরণের দাম দ্বারা নির্ধারিত হয়। মালিক যেমন তার উৎপাদিত মূল্য নির্ধারণের সময় কলকব্জার ক্ষয়প্রাপ্ত হিসাবটা করে মূল্যের সাথে তার সংযোজন করে, যাতে সে অর্থ দিয়ে ১০ বছর পরে নতুন কলকব্জা ক্রয় করতে পারে। এ কারণেই কার্ল মার্কস বলেছেন “ঠিক এই ভাবেই সাধারণ শ্রম শক্তির উৎপাদনের ব্যয় হিসেব করার সময় তার সঙ্গে ধরতে হবে বংশবৃদ্ধির খরচ, যাতে করে মজুরের জাত বেড়ে চলে, জীর্ণ মজুরের জায়গায় নতুন মজুর জায়গা নিতে পারে। এই ভাবে যন্ত্রপাতির ক্ষয়তির মত মজুরের ক্ষতি হিসেবে ধরা হয়। সুতরাং সাধারণ শ্রমশক্তির উৎপাদন ব্যয় হল মজুরের জীবন ধারণ ও বংশ রক্ষার খরচের সমান। এই জীবন ধারণ এবং বংশ রক্ষার খরচের মূল্য হলো মজুরী। এইভাবে নিরুপিত মজুরীকে ন্যূনতম মজুরী বলা হয়।” (কার্ল মার্কস; মজুরী শ্রম ও পুঁজি; ১৮৪৯)
তাই, আজকের বাজার দরে একটি শ্র্মিক পরিবার চলতে কত টাকা খরচ হয় তার হিসেব দরকার। স্বামী-স্ত্রী ও নিম্নতম দুই সন্তানের সাথে পিতা-মাতাদের অন্তত একজনকে যুক্ত করলে মোটামুটি পাঁচ জনের একটি পরিবারকে ধরা যেতে পারে। তাদের মাসিক খরচ কত সেটাই হতে হবে সেই পরিবারের উৎপাদন শ্রমে অংশগ্রহণকারী সদস্যদের মোট নিম্নতম মজুরী। সাধারণত পরিবার পিছু দুই জনকে যদি উৎপাদন কাজে যুক্ত ধরা হয় তাহলে পরিবারের মোট প্রয়োজনের অর্ধেক হতে পারে একজন শ্রমিকের নিম্নতম মজুরী। এর নিচে কোন মজুরী কোন ক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। শুধু তাই নয়, যেহেতু স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই শ্রমিক হিসেবে ধরা হতে পারে, তাই, সন্তানদের প্রতিপালন খরচও মালিককে নিতে হবে। এছাড়া তাদের লেখাপড়া, খেলাধুলা, সদস্যদের স্বাস্থ্য চিকিৎসা, বিনোদন এবং সর্বোপরি বাসস্থানের ব্যবস্থা অবশ্যই রাষ্ট্র ও/বা মালিককে নিতে হবে, যদি একটি ন্যায্য মজুরী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হয়। এমনকি পাকিস্তান আমলেও পাট শিল্প ও টেক্সটাইল শিল্প গুলোতে উপরোক্ত সুবিধাগুলো কিছুটা পরিমাণে হলেও মালিকরা বহন করতো। কেউ দাবি করতে পারে না যে, পাকিস্তান আমল থেকে এখন গার্মেন্টসগুলোতে মুনাফা কম হচ্ছে। অথচ, প্রাইভেটাইজেশনের জোয়ারে এখন প্রতিটি প্রয়োজনই মেটাতে হয় শ্রমিককে তার মজুরী থেকে। বেতন বাড়ার সাথে সাথে সবচেয়ে বেশি হামলে পড়ে বাড়ীওয়ালারা। লাভের গুড় পিপড়ায় খায়। আর দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকে হু হু করে। এবারও, মজুরী যতটাই বাড়–ক না কেন, এটাই ঘটবে। তাই, প্রতিবছরই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাথে মজুরীকে সমন্বয় না করলে টাকায় মজুরী বৃদ্ধি একটি হাওয়াই মিঠাই-এ পরিণত হতে বাধ্য। তাই, শুধু নিম্নতম মজুরী নির্ধারণই যথেষ্ট নয়, তার সাথে এই সমস্ত বিষয়গুলো যুক্ত করলেই মাত্র শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরী বৃদ্ধি ফলপ্রসূ হতে পারে। নতুবা শ্রমিকের জীবনে খুব কমই উন্নতি ঘটবে।
উপরের হিসেবে একটি পরিবারের মাসিক খরচ কত, আর শ্রমিকের নিম্নতম মজুরী কত হওয়া উচিত তা নিয়ে প্রগতিশীলদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। অনেকে ১৬, ১৮ বা ২০ হাজার টাকা মজুরীর কথা বলছেন। এই হিসেব ভুল নয়, তবে কতটা বাস্তব সেটা বিবেচনা করতে হবে। এই বিবেচনার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে হবে আমাদের দেশে বিভিন্ন শ্রমক্ষেত্রে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা, শ্রমিকের জীবনযাপন পরিস্থিতি, বেকারত্ব পরিস্থিতি, অন্যান্য শ্রমক্ষেত্রে মজুরী কাঠামোর পরিস্থিতি প্রভৃতিকেও।
পরিবারপিছু গড়ে দুইজনকে উৎপাদনক্ষম ধরলে মজুরী ৮ হাজার টাকার যে দাবী শ্রমিকরা তুলেছেন তাকে যুক্তিযুক্ত বলা যাবে। আমাদের সংগঠন বহু আগে থেকেই নিম্নতম ৫ মণ চালের মূল্যের সমান মজুরী দাবী করেছিল এই বিবেচনা থেকেই। এতে আরো গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল দ্রব্যমূল্য (বাড়ীভাড়াসহ) বৃদ্ধি যে আমাদের দেশে সাধারণত চালের দামের সাথে মোটামুটি সামঞ্জস্য রেখে বৃদ্ধি পায় এই বিষয়টিকে। তবে বর্তমানে শাসক শ্রেণী চালের দাম কম রেখে আর বাকী সবকিছুর দাম বৃদ্ধির যে অর্থনীতি চালাচ্ছে তাতে এই হিসেবেও কিছু সমস্যা হয়। তথাপি সরকার, মালিক ও শ্রমিকের কাছে এটা পরিস্কার থাকে যে, চালের দাম (সাথে সাথে অন্য সব দ্রব্যমূল্য) বাড়লে তাদের মজুরীও বাড়তে হবে। নতুবা টাকার অঙ্কে কোন মজুরীই কয়েকদিন পর শ্রমিকের প্রয়োজন মিটাতে সক্ষম হবে না।
শ্রমিক শ্রেণী আজ যে ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ তুলেছেন ৮ হাজার টাকা নিম্নতম মজুরীর, তাকে আমরা দৃঢ়ভাবে সমর্থন করি। সেই সাথে যুক্ত করতে বলি এই দাবি যে, অবশ্যই নিম্নতম মজুরীকে প্রতি বছর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাথে সমন্বয় করতে হবে। বিশেষভাবে বাড়ীওয়ালারা যেন শ্রমিকের মজুরী বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়িভাড়া বাড়াতে না পারে সেজন্য রাষ্ট্রীয় আইনগত সুরা থাকতে হবে। একইসাথে মালিক/সরকারের যৌথ উদ্যোগে শ্রমিকের জন্য স্বল্পমূল্যের বাসস্থান করতে হবে এবং এরকম কোন বাসস্থানের নিম্নতম ব্যবস্থা ছাড়া কোন কারখানা প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। পাশাপাশি শ্রমিক পরিবারের জন্য হাসপাতাল, ডে কেয়ার সেন্টার, স্কুল, খেলাধুলা আর বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। এসব কিছু মিলিয়েই নিুতম মজুরীর আন্দোলনকে দেখতে ও পরিচালনা করতে হবে।
শ্রমিক আন্দোলন থেকে বুর্জোয়া ‘শ্রমিক নেতা’দের উচ্ছেদ ব্যতীত
শ্রমিকশ্রেণীর কোন মঙ্গল হতে পারে না
পোশাক শিল্পে মজুরি সর্বনিম্ন
মালিকরা দাবি করে সর্বনিম্ন মজুরি বাড়ালে তারা লস খাবে। অথচ পোশাক শিল্প খাতই হলো বর্তমানে বাংলাদেশে সবচাইতে লাভজনক খাত। এর চেয়ে কম লাভজনক খাতগুলোতে নিম্নতম মজুরির সাথে তুলনা করলে বোঝা সম্ভব গার্মেন্টস মালিকদের দাবি কতটা মিথ্যা এবং তারা কত বেশি পরিমাণ লাভ করে।
× নির্মাণশিল্প ৯,৮৮২/-
× ট্যানারী শিল্প ৯,৩০০/-
× তেল মিল ৭,৪২০/-
× ব্যক্তিমালিকানাধীন সড়ক পরিবহন ৬,৩০০/-
× রি-রোলিং মিল ৬,১০০/-
× কোল্ড স্টোরেজ ৬,০৫০/-
× গ্লাস ৫,৩০০/-
× চাতাল ৭,১৪০/-
এখানে উল্লেখ্য যে, উপরোক্ত অনেক শিল্পেই শ্রমিকেরা বাড়িতে থেকে, গ্রামে থেকে কাজ করেন। ফলে ঢাকা বা নগরগুলোর চেয়ে তাদের খরচ কম, বিশেষত বাসা ভাড়া যাদের লাগে না। সে ক্ষেত্রে গার্মেন্টস শ্রমিকরা বড় নগরে থাকায় তাদের খরচ বেশি। অথচ সর্বনিম্ন মজুরি সবচেয়ে কম ৩,০০০/-। (প্রথম আলো’র সৌজন্যে)