আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বন্দ্ব এখনও প্রকট। সাম্রাজ্যবাদী প্রভু আর দেশীয় ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোর (সামরিক আমলাতন্ত্র, বুর্জোয়া ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজ প্রভৃতি) চাপে সমঝোতা না হলে এই দ্বন্দ্ব আরো তীব্র রূপ নিতে পারে। এটা বুর্জোয়া শাসকশ্রেণীর একটি গুরুতর সংকট। যদিও এটা সাধারণ জনজীবনকেও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।
নিজেদের সুবিধামত সংবিধান বদলে ফেলে এখন প্রধানমন্ত্রি সাফ জানিয়ে দিচ্ছেন সংবিধান মতেই নির্বাচন হবে। অর্থাৎ তার নেতৃত্বে সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। সংবিধান থেকে একচুলও তিনি নড়বেন না। অন্যদিকে বিএনপিসহ তাদের জোট/ঘরানার বুর্জোয়া দলগুলো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবীতে অনড়। তারা ২৪ অক্টোবরের পর সংঘাতময় আন্দোলনের হুমকি দিয়ে চলেছে। সরকার একে রাষ্ট্রীয় শক্তি দ্বারা দমনের পাল্টা-হুমকি দিচ্ছে। এই দ্বন্দ্বমান বুর্জোয়া দলগুলো একে অপরকে তৃতীয় শক্তি, ওয়ান-ইলেভেনের ভয়ও দেখাচ্ছে।
বুর্জোয়া সংকট নিরসনে প্রত্যেকেই বলছে ‘গণতন্ত্র’ রায় সংলাপই উত্তম। কিন্তু প্রত্যেকেই আবার তাল গাছটা ছাড়তে নারাজ। দালাল শাসকদের এই মুখোমুখি পরিস্থিতিতে বৈদেশিক প্রভুদের রাতের ঘুম হারাম। তারাও সকল বুর্জোয়া দলগুলোর অংশগ্রহণে ‘অবাধ’ ‘নিরপেক্ষ’ ‘শান্তিপূর্ণ’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য গলদঘর্ম। সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘ ফোন করে, বিশেষ দূত পাঠিয়ে, মার্কিন মন্ত্রি চিঠি দিয়ে সংলাপ-সমঝোতার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজিনা বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট রাজনীতিক নেতা বা মুরুব্বীর মত প্রকাশ্যেই কোন রাখ-ঢাক না করে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ-সেমিনারে বক্তৃতা বিবৃতি নসিহত করে চলেছে। দেশের বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী, সুশীলরাও সংলাপ-সমঝোতার, ‘অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ’ নির্বাচনের ফর্মূলা দিয়েই চলেছে।
এই যে শাসক শ্রেণী ও তার বৈদেশিক প্রভুদের ‘অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ’ নির্বাচনের ফর্মূলা তাকি শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তসহ ব্যাপক সাধারণ জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে, নাকি জনগণের শত্রু “ সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদ, দালাল আমলা-মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে?
বিগত ৪০ বছর ধরে যে নির্বাচনগুলো হয়েছে (তা দলীয় সরকারের অধীনেই হোক বা নির্দলীয় তত্ত্ববধায়ক সরকারের অধীনেই হোক) তাতে রাষ্ট্রক্ষমতার বড় ভাগটা জনগণের শত্রু শ্রেণীর কোন না কোন গোষ্ঠি দখল করেছে। অর্থাৎ, তারা হলো সাম্রাজ্যবাদ-ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের দালাল আমলা-মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ার বৃহৎ অংশ দুর্নীতিবাজ, রাষ্ট্রীয় ও জনগণের সম্পদ লুটপাটকারী, কমিশনভোগী, কালো টাকার মালিক, ঋণ খেলাপি, সামরিক শাসনের হোতা, সন্ত্রাসী-গডফাদার, কালোবাজারী, ভূমি দস্যূ, মাদক ব্যবসায়ী, নারী পাচারকারী, ধর্মব্যবসায়ী, ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী, রক্ষীবাহিনী-র্যাব-সেনাবাহিনী দিয়ে গণহত্যাকারী ও গুমকারী, সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ সৃষ্টিকারী ও রক্ষাকারী গডফাদার, মানবাধিকারবিরোধী, পীরবাদী, জঙ্গীবাদী, সংখ্যালঘু জাতি সত্ত্বার জমি-সম্পদ দখলকারী এবং চরম শ্রমিক-কৃষক বিরোধী নির্মম শোষক (যেমন, গার্মেন্ট মালিক) ব্যক্তিবর্গ।
এই সব গণশত্রুরাই নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে। শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত শ্রেণী, আদিবাসী জনগণকে শোষণ-শাসন করে। তাদের জমি-সম্পদ দখল করে। তারা গ্যাস-বিদ্যুৎ-জ্বালানী তেল, কৃষি উপকরণ ও নিত্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করে কৃষককে সর্বশান্ত করে, শ্রমিক-কৃষক-দরিদ্র জনগণের জীবন-জীবিকা বিপর্যস্ত করে তোলে। তারা ও তাদের নিজস্ব লোকেরা অল্প দিনেই আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়। তারা দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী ও ভারতীয় প্রভুদের স্বার্থ রক্ষা করে। তারা বিদেশী পণ্য দিয়ে দেশ ছেয়ে ফেলছে। জাতীয় শিল্প ধ্বংস করে বিদেশ নির্ভর শিল্প গড়ে তুলছে। দেশের প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানীর হাতে তুলে দিচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও নিরাপত্তা প্রশ্নে দাসত্বমূলক চুক্তি করছে। তারা উন্নয়নের নামে কৃষি জমি ও পরিবেশ ধ্বংস করছে। শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একদিকে মধ্যযুগীয় প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষা-সংস্কৃতি টিকিয়ে রেখেছে, অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী অপসংস্কৃতি আমদানী করে তরুণ-তরুণীদের কলুষিত করছে। তরুণ প্রজন্মকে মাদকাসক্ত করে বিপথগামী করছে।
এই সব গণবিরোধী কর্মসূচির বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলন-সংগ্রামকে প্রতিটি নির্বাচিত সরকারই দমন-নিপীড়ন চালিয়ে স্তব্ধ করে দিতে চাইছে। সন্ত্রাস দমনের নামে বিপ্লবী, গনতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের হত্যা-নির্যাতন করছে। প্রতিটি সরকারই গনবিরোধী নিত্য নতুন আইন ও বাহিনী বানিয়েছে। বর্তমানের র্যাব, ইন্ডিষ্ট্রিয়াল পুলিশ; অতীতের রক্ষীবাহিনী তার উজ্জ্বল প্রমাণ।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় বা নির্দলীয় যে কোন সরকারের অধীনেই হোক না কেন, যে কোন বুর্জোয়া দল বা গোষ্ঠিই মতায় যাক না কেন উপরে আলোচিত গণশত্রুরাই নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করবে, যে সরকার জনগণের মাথায় চড়ে বসবে এবং শোষণ-নিপীড়ন চালাবে।
তাই, শ্রমিক-কৃষক-আদিবাসী ও মধ্যবিত্ত জনগণকে বুর্জোয়া ফর্মূলার বিপরীতে তাদের নিজ নিজ শ্রেণী পেশার স্বার্থের অবস্থান থেকে, সর্বোপরি তাদের নিজেদের রাষ্ট্রমতার অবস্থান থেকে অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পূর্বশর্ত নির্ধারণ করে তার ভিত্তিতে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। জনগণের স্বার্থের গ্যারান্টিপূর্ণ শর্তারোপ করতে হবে। যাতে গণশত্রু শাসক শ্রেণীর স্বরূপ উন্মোচন করা যায়। গণদাবী পূরণের অনুপস্থিতিতে দেশ ও জনগণের শত্রুদের মধ্যকার ক্ষমতা ভাগাভাগির এই বুর্জোয়া প্রহসনমূলক নির্বাচন বয়কট করা জনগণের কর্তব্য হয়ে দাড়াবে।
-
সাম্প্রতিক লেখা
সংগ্রহ
বিষয়
-
Join 6 other subscribers
Blogroll
Top Clicks
- None