সিপিবি-বাসদ ও বামমোর্চার রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব

সিপিবি-বাসদ ও বামমোর্চা তাদের ভিন্ন ভিন্ন মঞ্চ থেকে বা ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম করছে। তাদের এই আন্দোলন-সংগ্রাম কতটা শাসক শ্রেণী ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বামপন্থী কমিউনিস্ট নামধারী এই দল ও জোটগুলো, বিশেষতঃ সিপিবি-বাসদ ’৭১ সাল থেকেই সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদের দালাল গণশত্রু প্রতিক্রিয়াশীল আওয়ামী চেতনার লেজুড়বৃত্তি করে আসছে। বামমোর্চার রাজনৈতিক লাইন ও কর্মসূচী তাদের সেদিকেই ধাবিত করে। ’৭১ পরবর্তীতে সিপিবি আওয়ামী লীগের গুণকীর্তন করে একদলীয় ফ্যাসিস্ট পার্টি বাকশালে যোগ দিয়েছিল। সিপিবি-বাসদ-বামমোর্চা নিজেদেরকে যতই বামপন্থী কমিউনিস্ট বলে দাবী করুক না কেন, বাস্তবে তারা বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী চেতনায় সজ্জিত, যা আমাদের দেশে সাম্রাজ্যবাদের দালালীতে পর্যবসিত হয়েছে। ’৭২ সালের সংবিধান কোন কালেও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক ছিল না। সেই সংবিধানকে পনঃপ্রতিষ্ঠার দাবীতে সিপিবি, বাসদ, এমনকি বামমোর্চাও সংগ্রাম করছে।
যুদ্ধাপরাধী বিচার প্রশ্নেও এই দল ও জোটগুলোর অভিন্ন অবস্থান দেখা যাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধী বিচার মূলতঃ আওয়ামী মহাজোটের ভোট রাজনীতির কর্মসূচী। বুর্জোয়া নির্বাচনী প্রধান প্রতিপ বিএনপি-জামাতকে কোনঠাসা করা এবং চাপে রেখে বিএনপি থেকে জামাত-শিবিরকে বিচ্ছিন্ন করাই এর প্রকৃত উদ্দেশ্য। এর মধ্য দিয়ে জনগণকে তারা প্রতারণা করছে এবং তাদেরকে বিভ্রান্ত করে ভোট রাজনীতিতে সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করতে চাচ্ছে। এই আওয়ামী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিকে ধামাচাপা দিয়ে সিপিবি-বাসদ-বামমোর্চা যুদ্ধাপরাধী বিচার প্রশ্নে আওয়ামী কর্মসূচি বাস্তবায়নে জোরেশোরে শোরগোল তোলে। তারা শত্রু কে বন্ধু হিসেবে উপস্থাপন করে। প্রধান শত্রু ক্ষমতাসীন আওয়ামী রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদকে উহ্য রেখে গৌন শত্রু জামাত ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে মূলতঃ প্রধান শত্রু‌‌‌ কে আড়াল করে। বাস্তবে তারা প্রধান শত্রু’র পক্ষ অবলম্বন করেছে। এই কর্মসূচীতে তারা একটি সরকারী হরতালও করেছে। যা আওয়ামী লীগের ভোট-কর্মসূচীকে জনপ্রিয় করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। এ কারণেই সরকার তাদের কর্মসুচিতে ব্যপকভাবেই সহায়তা করেছে।
যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার লঘু শাস্তির কারণে শাহবাগে তরুণ প্রজন্মের ব্লগারদের উদ্যোগে আন্দোলন হয়। এতেও সিপিবি-বাসদ-বামমোর্চার ছাত্র-তরুণদের বড় ধরনের ভূমিকা ছিল। এ আন্দোলন শুরুতে সরকার বিরোধী ন্যয্য ক্ষোভ থেকে শুরু হলেও এই দলগুলো এখানে সঠিক দিশা দিতে ব্যর্থ হয় তাদের সংশোধনবাদী বুর্জোয়াদের লেজুড়বৃত্তির রাজনৈতিক লাইনের কারণে। তারা এই আন্দোলনকে অরাজনৈতিক আখ্যা দিয়ে মূলতঃ আন্দোলনকে দিশাহীন করে আওয়ামী লীগের হাতে তুলে দেয়। গণজাগরণ মঞ্চে সিপিবি-পন্থী ছাত্রনেতা লাকি আকতারকে ছাত্রলীগের মাস্তানরা আক্রমণ করে আহত করে হাসপাতালে পাঠায়। সমস্ত বুর্জোয়া পত্রপত্রিকা ছাত্রলীগের মাস্তানদের কর্মকান্ড বলে প্রচার করলেও সিবিপি নেতারা তা গোপন করে লাকিকে দিয়ে মিথ্যা বলায় এবং আওয়ামী সন্ত্রাসীদেরকে রা করে। কি জঘন্য লজ্জজনক ঘটনা! এভাবে দ্রুতই এই শাহবাগ আন্দোলন আওয়ামী এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ারে পরিণত হয়। শাহবাগ আন্দোলন সামগ্রিকভাবে যুদ্ধাপরাধী বিচার প্রশ্ন সামনে না এনে শুধু আওয়ামী পরিকল্পিত বিচারাধীন কিছু সংখ্যক ব্যক্তির ফাঁসির দাবীতে মাতম তোলে। তারা পাকিস্তানী ১৯৫ জন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীসহ দেশের হাজার হাজার যুদ্ধাপরাধীর তালিকা প্রকাশ ও বিচার দাবী করেনি। তারা পাকিস্তানী মূল যুদ্ধাপরাধী ১৯৫ জনকে ক্ষমা করে দেবার জাতীয় বিশ্বাসঘাতক ভূমিকার জন্য আওয়ামী লীগ বা শেখ মুজিবের বিচার দাবি করছে না, বরং মুজিবকেই মহিমান্বিত করছে। তারা ’৭১-পরবর্তী বিগত ৪২ বছর ধরে প্রায় একই রূপ অসংখ্য মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের দাবি ঘুণারে তোলেনি। দেশের শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের শোষণ-নিপীড়ন তথা জাতীয় জীবনের হাজারো সমস্যাতো দূরের কথা।
এই বামপন্থীদের সামগ্রিকভাবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী কোন ভূমিকা নেই। সাম্রাজ্যবাদের কিছু কিছু পলিসিকে তারা বিরোধিতা করে বটে, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের সাথে গাটছড়া বাধা দেশীয় দালাল বুর্জোয়া শাসক শ্রেণী উচ্ছেদের কর্মসূচী ছাড়া সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা হয় না। যা সিপিবি-বাসদ-বামমোর্চার রাজনৈতিক লাইনেই নেই। বরং তারা সাম্রাজ্যবাদের দালালদের এক পক্ষের বিরুদ্ধে অন্য পক্ষের সাথে জোট করে এবং তাদের বিটিমের ভূমিকা পালন করে। এভাবে এই দলগুলো শ্রমিক শ্রেণীর পার্টিতো দুরের কথা, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক ভূমিকাও সার্বিকভাবে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। তারা সমাজ গণতন্ত্রী। বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যেই তারা কিছু সংস্কার করতে চায়। তাই তারা বুর্জোয়া সংসদীয় নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রমতা দখল করতে চায়। যা সত্যিকারের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। তারা বুর্জোয়া সংবিধানকে মান্য করে। বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষমতার প্রধান শক্তি সেনাবাহিনী-পুলিশকে শ্রমিক শ্রেণী ও জনগণের বাহিনী মনে করে।
সিপিবি-বাসদের নতুন ঐক্যের শ্লোগান হচ্ছে ‘লুটেরা ধনিক শ্রেণীর দ্বিদলীয় রাজনীতি বর্জন করে জনগণের বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলুন’। লুটেরা দ্বিদলীয় রাজনীতি বর্জন করতে বলা হলেও সমগ্র বুর্জোয়া শাসক শ্রেণী এবং তাদের সেনাবাহিনী, বিচারব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র, সংসদ, অর্থাৎ তাদের এই প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রযন্ত্রের সমূল উচ্ছেদের কথা বলে না, বরং তাদেরকে মহিমান্বিত করে। শুধু বুর্জোয়া দ্বিদলীয় রাজনীতি বর্জন করলেই শ্রমিক শ্রেণীসহ জনগণের হাতে ক্ষমতা আসতে পারে না। দ্বিদলীয় রাজনীতি বর্জনের কথা সংস্কারবাদী কর্মসূচীর মধ্যেই পড়ে। সিপিবি-বাসদ-বামমোর্চা হচ্ছে বুর্জোয়া লেজুড়-সংস্কারবাদী সংগঠন। তারা বিপ্লবকে ধারণ করে না। তাই তারা প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও কর্মসূচি ধারণ করে না। এদের বিরোধিতা ছাড়া গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলন এগোতে পারে না।

About andolonpotrika

আন্দোলন বুলেটিনটি হলো বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন ও বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের একটি অনিয়মিত মুখপত্র
This entry was posted in Uncategorized. Bookmark the permalink.

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s