জাতীয় সংসদ নির্বাচন এলেই বুর্জোয়া দলগুলোর কোন্দল চরমে পৌঁছে। সচেতন জনগণ বুঝেন এই দ্বন্দ্ব সংঘাত খুনোখুনির অন্তর্নিহিত কারণ। ক্ষমতার বড় ভাগটা দখলে রাখা বা দখলের নেয়ার অপপ্রয়াস হিসেবেই এই কুত্তা-কামড়াকামড়ি। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই জনগণ বুর্জোয়া দলগুলোর এই অপসংস্কৃতি তথা ‘গনতন্ত্রে’র সাথে পরিচিত। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না।
বুর্জোয়া শাসক ও তাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের চরম শোষণ-লুটপাট, দমন-নির্যাতনে জনগণের প্রাণ এমনিতেই ওষ্ঠাগত। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বুর্জোয়া দলগুলো কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন করবে তা নিয়ে কোন্দল, সংঘাত এবং হানাহানি। আওয়ামী সরকার মতার বড় ভাগটা দখলে রাখার জন্য ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করছে (আইন-আদালত সংসদ ও বাহিনীর দ্বারা)। তারা ২০০৭ সালের ১/১১ অজুহাত দেখিয়ে সংসদ ও আদালতের মাধ্যমে সংবিধান থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করেছে। যা বুর্জোয়া দলগুলোর হানাহানির কারণেই বুর্জোয়া শ্রেণী গ্রহণ করেছিল। আওয়ামী সরকার তাদের অধীনে নির্বাচন করতে বিএনপি জোটকে বাধ্য করতে চাচ্ছে। কিন্তু বিএনপি তাতে নারাজ। এই বুর্জোয়া দলগুলো নিজ নিজ গোষ্ঠীগত স্বার্থে অটল। কেউই মতার বড় ভাগটা ছাড়তে চাচ্ছে না। দেশ-জনগণের স্বার্থ গোল্লায় যাক তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। আওয়ামী সরকারের চার বছরে অসংখ্য গণবিরোধী কাজ তারা করেছে। কিন্তু বিএনপি এর বিরুদ্ধে শক্ত কোন প্রতিবাদ আন্দোলন করেনি। আজ তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে জান-প্রাণ দিয়ে লাগাতার হরতাল করছে; আর আওয়ামী সরকার রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদ চালিয়ে তা দমন করছে।
বুর্জোয়া দলগুলো এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। নির্বাচন এলেই তারা জনগণকে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যা প্রকৃতপক্ষে তারা করতে সক্ষম নয়। কেন নয়, তা আমরা আমাদের আগের সংখ্যায় বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছি। সংক্ষেপে- ‘৭১-এর পর আওয়ামী লীগ ও তার নেতা শেখ মুজিব পাকিস্তানী মূল যুদ্ধাপরাধীদের এবং তাদের দোসর এই দেশের রাজাকার আলবদরদের ব্যাপক অংশের রাজনৈতিক অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছিল। জামাত-শিবিরসহ বাকীদেরকে পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বুর্জোয়া দলগুলো বিগত ৪২ বছর ধরে সমাজে ও রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছে। আজকে জনগণের ন্যায্য দাবীকে ইস্যু করে আওয়ামী সরকার প্রহসনের বিচার করছে মাত্র। যুদ্ধাপরাধী বিচারের নামে মূলতঃ তাদের নির্বাচনী প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি-জামাতকে কোনঠাসা করছে। জনমতকে নিজেদের নির্বাচনী স্বার্থে ব্যবহার করে বিএনপি-জামাতের আন্দোলনকে হত্যা, গ্রেপ্তার, মামলা, হামলা করে তথা রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদ চালিয়ে দমন করছে।
আওয়ামী সরকার তাদের নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বীদের কোনঠাসা করার পাশাপাশি তাদের মাঝে ভাঙ্গন সৃষ্টির অপচেষ্টায় জামাতের সাথে গোপন আঁতাত করে তাদের নেতা কাদের মোল্লার অপরাধের লঘু শাস্তি দিলে সৃষ্টি হয় শাহবাগ আন্দোলন। শাহবাগ আন্দোলন উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত তরুণদের ন্যায্য আবেগ নিয়ে শুরু হলেও তাদের গুরুতর রাজনৈতিক দুর্বলতার কারণে আওয়ামী সরকার এই আন্দোলনের কাঁধে সওয়ার হয়ে এটিকে একটি প্রহসনের আন্দোলনে পরিণত করতে সম হয়। কিন্তু জামাতের সাথে আপোষ-আঁতাত বিঘ্নিত হয় আপাততঃ। আর জামাত-শিবির সাম্রাজ্যবাদ ও শাসক শ্রেণীর মদদে-আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে বিগত দিনে বিকশিত ও শক্তিশালী হয়ে আজ তারা ‘৭১-এর খুনী রাজাকার নেতাদের বাঁচানোর জন্য দোর্দন্ড প্রতাপে প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলনে মাঠে নেমেছে। বিএনপি তাদের মদদ দিচ্ছে। আর আওয়ামী সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে পাখির মত গুলি করে আন্দোলনকারীদের ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করছে। খুন-জখম, মামলা-হামলা, গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে প্রেরণ করছে। শাহবাগ আন্দোলন, যুদ্ধাপরাধী বিচার এবং আগামী নির্বাচনকে ঘিরে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাত, জাতীয় পার্টিসহ বুর্জোয়া পার্টিগুলো এবং রাষ্ট্রযন্ত্র দেশে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে চলছে।
এ ছাড়াও শাসক শ্রেণীর সকল গোষ্ঠী বিবিধ ষড়যন্ত্র-চক্রান্তে লিপ্ত। একদিকে সংখ্যালঘু হিন্দু জনগণের উপর আক্রমণ করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর চেষ্টা, অন্যদিকে শাহবাগ আন্দোলনে যুক্ত কতিপয় ব্লগারের দ্বারা জনগণের ধমীয় অনুভূতিতে আঘাতকে কেন্দ্র করে দেশের মুসলিম জনতাকে ধর্মীয় মৌলবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ভোট রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করার অপপ্রয়াসে আওয়ামী লীগ ধর্মীয় মৌলবাদীদের সাথে নির্লজ্জ আপোষ করে। তাদের দাবীমত শাহবাগ আন্দোলনে যুক্ত ব্লগারের কয়কজনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে হাজতে পাঠায়। এভাবে তারা ধর্ম প্রশ্নে যে কোন মত পোষণ ও প্রকাশ করার গণতান্ত্রিক অধিকারকে পদদলিত করে। অন্যদিকে কিছু ব্লগারের ধর্ম প্রশ্নে বক্তব্য/মতকে পুঁজি করে বিএনপি-জামাত, এমনকি মহাজোট সরকারের শরীকদল জাতীয় পার্টি জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিকে ভোট রাজনীতিতে ব্যবহার করার হীন স্বার্থে ধর্মীয় মৌলবাদকে উস্কে দেয়।
ভোট রাজনীতি নিয়ে বুর্জোয়া দলগুলোর কামড়াকামড়ি হানাহানির সুযোগে এবং তাদের মদদে ধর্মীয় মৌলবাদীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তারা ধর্ম হেফাজতের নামে দেশে কার্যত প্রতিক্রিয়াশীল ব্লাসফেমী আইন করার দাবী তুলছে। ধর্ম হেফাজতের নামে মূলতঃ ১৩ দফা প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দাবী তুলে ধরছে। যা দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, নারী অধিকার ও ধর্ম প্রশ্নে মধ্যযুগীয় বর্বর আইনের দাবি। দেশকে আফগানিস্তানের মত তালেবানী রাষ্ট্র বানানোর অপচেষ্টা।
হেফাজতে ইসলাম তাদের ১৩ দফা দাবী আদায়ে ৫ মে ঢাকা অবরোধ করে। হাসিনা সরকার একে পুলিশ-র্যাব-বিজিবি দ্বারা নির্মমভাবে দমন করেছে। অবরোধকারীরা ঢাকার শাপলা চত্বরে সমাবেশিত হওয়ার সময় পুলিশ-র্যাব ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের আক্রমণের সূত্র ধরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। লক্ষ লক্ষ মানুষ শাপলা চত্তরে অবস্থান নেয় এবং সরকার বিরোধী ভূমিকায় চলে যায়। বিএনপি-জামাত ও জাতীয় পার্টি পূর্ব পরিকল্পিতভাবে হেফাজতের উপর ভর করে সরকার পতনের, অথবা অন্তত ভোট রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে বেকায়দায় ফেলার ষড়যন্ত্র করেছিল। সরকার আতংকিত হয়ে ফ্যাসিস্ট কায়দায় রাতের অন্ধকারে তার যৌথ বাহিনী দিয়ে হাজার হাজার রাউন্ড গুলি, টিয়ারশেল, রাবার বুলেট, জলকামানসহ সমস্ত ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে অজানা সংখ্যক মানুষ হত্যা ও অগণিত আহত করার মধ্য দিয়ে হেফাজতকে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য করে পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসে।
আওয়ামী সরকার এখন শাহবাগ ও ধর্মীয় মৌলবাদ উভয়কে বাগে রাখার চেষ্টা করছে। একদিকে বলছে বাংলাদেশে ব্লাসফ্যামী আইন করা হবে না। অন্যদিকে বলছে দেশ চলবে নবীজির দেখানো পথে। এই সব কথাই বিভ্রান্তিকর ও প্রতারণামূলক।
বুর্জোয়া দলগুলোর নির্বাচনী রাজনীতির হানাহানিতে জনগণ অতিষ্ঠতো বটেই, বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী প্রতিষ্ঠান এমনকি বুর্জোয়া ব্যবসায়ীরাও হতাশ হয়ে পড়ছে। তারা বড় দুই দলের সমঝোতার দুতিয়ালী করছে। কিন্তু কাজ খুব একটা হচ্ছে না। এটা শাসক শ্রেণীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের অতি-তীব্রতাকেই প্রকাশ করে। বড় দুই দলই যা বলছে তার অর্থ হলো ভাগ যেভাবেই হোক, তাল গাছটা আমার।
এ অবস্থায় সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদের ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত-হস্তপে-খবরদারী একেবারে নগ্নভাবে চলছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনাসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা ঘন ঘন বৈঠক করছে। আর নিজেদের সুবিধা আদায়ের সুযোগের সন্ধান করছে। অবশেষে সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব সংস্থা জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব, বানকি মুনের বিশেষ দুত অস্কার ফারনানদেজ তারানকো দুই দলকে সংলাপে বসার নির্দেশ দিয়ে গেল। তারাও মাথা ঝুলালো, বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীরা ক্ষীণ আশার আলো দেখলো। কিন্তু যে লাউ সেই কদু। সরকার এবার এক মাসের জন্য সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করলো নিজেদের ও পরে দলগুলোর সভা-সমাবেশের সুযোগ রেখে। বুর্জোয়া দলগুলোর এই হানাহানির সুযোগ নিতে পারে সাম্রাজ্যবাদের দালাল তৃতীয় শক্তি, যার আশংকা এখন সর্বস্তরে আলোচিত হচ্ছে।
সাম্রাজ্যবাদ-ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ এবং বুর্জোয়া দলগুলোর এই সব অপকর্মের বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষক ও দরিদ্র জনগণকে সতর্ক থাকতে হবে। আর বুঝতে হবে নির্বাচিত সরকার বা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার যার অধীনেই নির্বাচন হোক না কেন, শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ জনগণের কোন স্বার্থ এতে নেই। বুর্জোয়া নির্বাচনে যে দলই সরকার গঠন করুক না কেন তারা আওয়ামী মহাজোট সরকারের মতই শোষণ-লুটপাট চালাবে। তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়াবে। খনিজ সম্পদ বিদেশে পাচার করবে। সার ও কৃষি উপকরণের মূল্য বাড়াবে। কিন্তু কৃষক কৃষি পন্যের ন্যায্য মূল্য পাবে না। চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী বন্ধ হবে না। সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদের উচ্ছেদ হবে না।
তাই, শ্রমিক-কৃষক ও দরিদ্র এবং সাধারণ মধ্যবিত্ত জনগণের করণীয় হচ্ছে এই বুর্জোয়া ভোটবাজী রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করা। নিজ নিজ শ্রেণী পেশার কর্মসূচীর ভিত্তিতে ঐক্য ও আন্দোলন গড়ে তোলা। সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদ দালাল আমলা-মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া শ্রেণী ও তাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা উচ্ছেদ, সমাজতন্ত্রমুখীন নয়াগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিপ্লবী আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়া। এ পথেই নিপীড়িত জনগণের মুক্তি আসবে।
-
সাম্প্রতিক লেখা
সংগ্রহ
বিষয়
-
Join 6 other subscribers
Blogroll
Top Clicks
- None