বাংলাদেশে আদিবাসী বিতর্ক ও তাদের মুক্তি প্রসঙ্গে

বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়া আদিবাসী হিসেবে পরিচিত অন্যান্য জাতিসত্ত্বা রয়েছে তা দেশের শাসক শ্রেণী স্বীকৃতি দেয় না। পররাষ্ট্রমন্ত্রি দীপুমনিসহ সরকারের মন্ত্রিরা বলছে বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই। যেমন একজন জীবন্ত মানুষকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে বলছে ক্রশফায়ারে মৃত্যু হয়েছে। এমনি মিথ্যা সংস্কৃতির উপর দাঁড়িয়ে আছে সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদের দালাল বড় ধনী শ্রেণী ও তার লুটেরা শাসন ব্যবস্থা। ‘৭২-এর সংবিধানেই তৎকালীন মুজিব সরকার আদিবাসীদের কোন ধরনের অধিকার স্বীকার করেনি। সেই সংবিধানের ৩নং ধারায় বলা হয়েছে, “বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে, বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন।” এই বক্তব্যকে তখনই বিরোধিতা করেছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ন লার্মা। আর শেখ মুজিব চাকমা নেতা লার্মাকে বাঙালি হয়ে যেতে বলেছিল। সে কারণেই সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বার জনগণ পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র বিদ্রোহ করেছিল।
‘৯৭ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার এক প্রতারণাপূর্ন শান্তিচুক্তি করে সেই সংগ্রামের অবসান করে। আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সমতলের আদিবাসী তথা ক্ষুদ্র জাতি ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের অধিকারের স্বীকৃতি, তাদের জমি, জলাধার এবং বনএলাকার অধিকার সংণের বিশেষ ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
কিন্তু মহাজোট সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আদিবাসী তথা সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বাগুলোকে জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। তাদেরকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও উপজাতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি বিশ্ব আদিবাসী দিবসের কোন অনুষ্ঠানে সরকারী কর্মকর্তাদের অংশ না নেওয়া এবং কোন সহযোগিতা বা পৃষ্ঠপোষকতা না করার নির্দেশ দিয়েছে। বলা হয়েছে, এ দেশে কোন আদিবাসী নেই। এভাবে সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বার অধিকারকে অস্বীকার করেছে। তাদের নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহারের সাথেই তারা বেঈমানী করেছে।
পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল নিয়ে বিএনপি‘র নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোট আন্দোলন করলেও আদিবাসী তথা সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বার সাংবিধানিক স্বীকৃতির প্রশ্নে কোন কথা নেই। বাঙালি বড় ধনী শ্রেণীর প্রতিনিধি আওয়ামী-বিএনপি জোটের সাথে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠির কোন পার্থক্য নেই। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী যেমনি বাঙালিসহ অন্যান্য জাতির অধিকার স্বীকার করতো না এবং উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সকল জাতির উপর চাপিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করেছিল, তেমনি বাঙালি বুর্জোয়া শাসকরাও বাংলাদেশের অন্যান্য জাতিসত্ত্বার অধিকার ও বিকাশকে অস্বীকার করছে।
বাংলাদেশের শাসক বড় ধনী শ্রেণী কেন এ দেশে আদিবাসী নেই বলছে এবং কেন সংবিধানে এর স্বীকৃতি দিচ্ছে না? কেন উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠি তারা বলছে? এর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থটা কি?
এর কারণ হলো এই স্বীকৃতি দিলে তাদেরকে ভূমির অধিকার এবং জাতি হিসেবে আত্মনিয়ন্ত্রন অধিকার ও বিকাশের অধিকার দিতে হয়। বুর্জোয় বড় ধনীদের স্বার্থেই আওয়ামী লীগ সরকার সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বার জনগণকে সংবিধানে জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করছে। সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্যই এ দেশে আদিবাসী নেই প্রমাণ করার অপচেষ্টা করছে।
আজকে সরকার কুযুক্তি করছে এই ভূখন্ডে আদিকাল থেকে বাঙালিরা বসবাস করে আসছে, তাই বাঙালিরাই হচ্ছে এখানকার আদিবাসী। ইতিহাসগতভাবেও এ তথ্য সঠিক নয়। আদিতে এ ভূখন্ডে মুন্ডা জাতি বাস করতো। গবেষণায় দেখা যায়, এখানে ১৭ হাজার বছর ধরে মানুষ বাস করলেও বাঙালিরা বাস করছে মাত্র ১ হাজার বছর ধরে। আর বাংলা বর্ণমালার বয়স মাত্র ৫০০ বছর। সে অর্থে সংখ্যালঘু জাতি সত্ত্বার জনগণই আদিবাসী।
সমতলের আদিবাসীরা বাঙালিদের মধ্যে অনেক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করেন। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীরা কেন্দ্রীভূতভাবে বসবাস করেন। এখানকার পরিস্থিতি আরো ভিন্ন। এখানকার ভূখণ্ড আর বাঙালি অধ্যুষিত সমতলের ভূখণ্ড ঐতিহাসিকভাবে এক ভূখণ্ড নয়। মাত্র ৫০ বছর আগেও এ অঞ্চলে বাঙালিরা ছিল না বললেই চলে। ভারতবর্ষ বিভক্তির সময় ১৯৪৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের বসবাস ছিলো মাত্র ১.৫ শতাংশ। যারা মূলতঃ চাকুরী ও ব্যবসায়িক উদ্দেশে সাময়িকভাবে সেখানে বসবাস করতো। বর্তমানে সেখানে বাঙালির সংখ্যা ৫০ শতাংশের বেশি। বাঙালি বড় ধনী শ্রেণী সমতলের ভূমিহীন-গরীব কৃষকদের পাহাড়ে পুনর্বাসন করে পাহাড়ীদেরকে ইতিমধ্যেই সংখ্যালঘুতে পরিণত করে ফেলেছে।
আদিবাসী শব্দটার সংজ্ঞা নিয়েও রাষ্ট্র ও শাসকশ্রেণী জঘন্য প্রতারণা করছে। আদিকাল থেকে বাস করে যারা তারাই আদিবাসী এমন ধারণা-ব্যাখা পৃথিবীর কোথাও নেই যদিও এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক বটে। এমনকি সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদীদের প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘও এ সংজ্ঞা বলে না। ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘ এ বিষয়ে যে সংজ্ঞা গ্রহণ করেছে তাহলোÑ “আদিবাসী সম্প্রদায়, জনগোষ্ঠী ও জাতি বলতে তাদের বোঝায়, যাদের ভূখন্ডে প্রাক আগ্রাসন এবং প্রাক উপনিবেশ থেকে বিকশিত সামাজিক ধারাসহ ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রয়েছে, যারা ঐ ভূখন্ডে বা ভূখন্ডের কিয়দংশ বিদ্যমান অন্যান্য সামাজিক গোষ্ঠী থেকে স্বতন্ত্র মনে করে। বর্তমানে তারা সমাজে প্রান্তিক জনগোষ্ঠিভুক্ত। এবং নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও আইন ব্যবস্থার ভিত্তিতে জাতি হিসেবে তাদের ধারাবাহিক বিদ্যমানতার আলোকে তারা তাদের পূর্ব পুরুষদের ভূখন্ড ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ভবিষ্যত বংশধরদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।” এই সংজ্ঞা অনুযায়ী বাংলাদেশের সকল অঞ্চলে সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বাসমূহের জনগণ আদিবাসী হিসেবে পরিচিত।
আদিবাসী জনগণের উপর জাতিগত নিপীড়ন বিরোধী পাহাড়ে ও সমতলে বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠন গড়ে উঠেছে। এসব সংগঠন শাসক শ্রেণীর কাছে সাংবিধানিক স্বীকৃতি, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন, আদিবাসীদের মানব অধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন এ জাতীয় কিছু সংস্কারমূলক দাবী-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করছে। এরা শাসক শ্রেণীর পাতা ফাঁদে ফেলছে এই জনগণকে। অর্থাৎ আদিবাসী কি আদিবাসী না এই বিতর্ক সামনে এনে প্রচলিত সংবিধানে স্বীকৃতির দাবী তুলে মূলতঃ জাতি হিসেবে স্বীকৃতি ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে ধামাচাপা দিচ্ছে। সন্তু লারমা এক সেমিনারে বর্তমান রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের মনোভাব পরিবর্তনের তাগিদ দিয়েছেন। এখানেই শ্রেণী মূল্যায়ন ও শ্রেণী সংগ্রাম অনুপস্থিত।
পার্বত্য চট্টগ্রামে জেএসএস এবং ইউপিডিএফ-এর মধ্যে মৌলিক লাইনগত ও কর্মসূচীগত কোন পার্থক্য নেই। তারা জাতিগত সংগ্রামের সাথে সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লবকে যুক্ত করে না। সঠিক রাজনৈতিক দিশার অভাবে এবং শাসব শ্রেণীর মদদে পাহাড়ি সংখ্যালঘু জাতিগুলোর মাঝে অসংখ্য গ্র“পের সৃষ্টি হয়েছে। ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত চলছে। যার ফায়দা লুটছে উগ্র বাঙালী জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়া শাসক শ্রেণী।
আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবী অবশ্যই ন্যায্য। কিন্তু সাংবিধানিক স্বীকৃতিই যথেষ্ঠ নয়; সমস্যার প্রকৃত সমাধানও নয়। কারণ, এই সংবিধানটাই গণতান্ত্রিক নয়। বাংলাদেশ বাঙালির রাষ্ট্র বলা হলেও সব বাঙালি, ৯০% ‘বাঙালি’ এই রাষ্ট্রের মালিক নয়। বাঙালি শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তসহ ব্যাপক জনগণ শোষিত-নিপীড়িত। এই রাষ্ট্রের মালিক বড় বড় ধনী ‘বাঙালি’রা এবং তাদের বৈদেশিক প্রভু সাম্রাজ্যবাদীরা।
তাই বাঙালি শ্রমিক-কৃষক-আদিবাসী নির্বিশেষে নিপীড়িত জনগণকে সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদ ও তাদের দেশীয় দালাল বুর্জোয়া শাসক শ্রেণীর শোষণমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিবর্তনের বিপ্লবী কর্মসূচীর ভিত্তিতে সংগঠিত হতে হবে। এর সাথে জাতিগত প্রশ্নে নির্দিষ্টভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক সায়েত্ত্বশাসন, অন্যান্য আদিবাসী অধ্যুষ্যিত এলাকায় বিশেষ আঞ্চলিক প্রশাসন গড়ে তোলা, খোদ কৃষকের হাতে জমি এই নীতির ভিত্তিতে সকল আদিবাসীকে জমিতে অধিকার প্রতিষ্ঠা (দলিল থাক বা না থাক), খনিজ ও বনজ সম্পদ প্রথমে আদিবাসীদের উন্নয়নে ব্যবহার প্রভৃতি কর্মসূচি আনতে হবে। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদে সজ্জিত শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বেই কেবলমাত্র এ জাতীয় বিপ্লবী ধারার সংগঠন গড়ে উঠতে পারে। সমাজতন্ত্রের লক্ষে নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে হবে। এ পথেই আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারসহ সার্বিক মুক্তি সাধিত হতে পারে।

About andolonpotrika

আন্দোলন বুলেটিনটি হলো বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন ও বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের একটি অনিয়মিত মুখপত্র
This entry was posted in Uncategorized. Bookmark the permalink.

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s