বিগত দুই দশক ধরেই ইসলামী মৌলবাদী শক্তিগুলো বারে বারে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ড.আহমদ শরীফকে মুরতাদ ঘোষণা করে তার ফাঁসির দাবিতে দেশজুড়ে আন্দোলন গড়ে তোলা, তসলিমা নাসরিনকে দেশছাড়া করা, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন গড়া ছাড়াও বিশ্বপরিস্থিতির সাথে যুক্তভাবে এই শক্তিগুলো আহমদ রুশদী, ইসলামের নবীর অবমাননা, ছবি নির্মাণ ইত্যাকার বিভিন্ন ইস্যুতে আগেও বহুবার আন্দোলন করেছে। তবে সম্প্রতি শাহবাগ আন্দোলনের নাস্তিক ব্লগার ইস্যুর উছিলা ধরে হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে ১৩ দফা দাবী পেশ, ৬ এপ্রিল স্বৈরাচারী সরকারের বাধা উপেক্ষা করে বিশাল মহাসমাবেশ, ৫ মে ঢাকা অবরোধ ও পরবর্তী ঘটনাবলী তাদেরকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে।
যদিও তারা বলছে যে, তারা কোন রাজনৈতিক দল নয়, তাদের রাজনৈতিক কোন আকাংখা বা দাবী নেই, ইসলাম ও নবীর মর্যাদা রাই তাদের উদ্দেশ্য, কিন্তু তাদের দাবীগুলো এবং তাদের বক্তব্য-কথাবার্তা সবই তাদের ধর্মবাদী রাজনৈতিক চরিত্রকে পরিস্কার করে তুলে ধরে। তারা পরিস্কারই বলেছে, ক্ষমতায় থাকতে হলে বা যেতে হলে ১৩ দফা মানতে হবে। ১৩ দফায় তারা পরিস্কারভাবেই সাংবিধানিক, আইনগত ও সামাজিক বিধিবিধানগত কর্মসূচি তুলে ধরেছে, যা নির্দিষ্ট রাজনীতিকে প্রকাশ করছে। তারা পরিস্কারভাবেই একটি ইসলামী মৌলবাদী রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনেরই কিছু দিকের কথা বলছে।
* এ ধরনের একটি ধর্মবাদী রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার কর্মসূচিকে কেন আমরা বিরোধিতা করি এবং কেনইবা সেটা একটি প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে প্রতিবন্ধক?
১৩-দফায় যে বিষয়গুলোকে টার্গেট করা হয়েছে সেগুলো হলো সংবিধান, ধর্ম প্রশ্নে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, নারী প্রশ্ন, কাদিয়ানী প্রশ্ন, সাংস্কৃতিক প্রশ্ন ইত্যাদি।
যদিও হেফাজতে ইসলাম আলোচনার কেন্দ্রে এখন এসে পড়েছে, কিন্তু তারা ছাড়াও যতসব ইসলামী দল বা সংগঠন দেশের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে দাবী দাওয়া নিয়ে মাঠে নামে তারা কম-বেশী একই ধরনের দাবী ও কর্মসূচিই তুলে ধরে।
এক কথায় এগুলো একটি ফ্যাসিবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠারই কর্মসূচি মাত্র। যেখানে ভিন্নমত প্রকাশকে বর্বর রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা দমনের ব্যবস্থা করা হবে, নারীদেরকে অধস্তন প্রাণী হিসেবে সমাজে রাখা হবে, সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে সমাজকে মধ্যযুগীয় কুপমণ্ডুকতায় নিয়ে যাওয়া হবে।
এ বিষয়গুলোতে আমরা নিচে কিছুটা আলোচনা করছি।
১। ধর্মীয় মৌলবাদীরা সংবিধানে ইসলাম ধর্মীয় বিশ্বাসকে আনার জন্য বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম, আল্লাহর উপর বিশ্বাস ও আস্থাকে রাখা ও যুক্ত করার কথা বলে। এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হলো, এদেশের ৯০% মানুষ মুসলমান, তাই এটাই করা উচিত।
বাস্তবে জনগণের ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে ব্যবহার করার অপপ্রয়াশে কোন ধর্মীয় সংগঠন নয়, বরং শাসক শ্রেণীর বুর্জোয়া তথাকথিত গণতান্ত্রিক দল ও নেতারাই সংবিধানে এগুলো যুক্ত করেছে। হাসিনা সরকার শুধু আরো শঠতার সাথে গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া ও প্রগতিমনা মধ্যবিত্তদেরকে হাতে রাখার জন্য সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্মের পাশাপাশি ধর্মনিরপেতা যুক্ত করে আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস সংক্রান্ত বাক্যটিকে সরিয়ে দিয়েছে। আর এতেই মৌলবাদীরা আপত্তি করছে। যদিও শেখ হাসিনা ৩ মে এক সংবাদ সম্মেলনে পরিস্কারভাবেই ব্যাখ্যা করেছে যে, নীতিগতভাবে মৌলবাদীদের এ দাবীর সাথে তাদের কোন বিরোধ নেই।
দেশের ৯০% জনগণ মুসলমান এ যুক্তিতে সংবিধানকেও মুসলমান বানাতে হবে, এটি সংখ্যাগুরুর নামে একটি ফ্যাসিবাদী যুক্তি ছাড়া আর কিছু নয়। এ যুক্তি মানার অর্থ হলো, যেসব দেশে খৃষ্টান বেশী সেখানে খৃষ্ট ধর্মের বিধানে রাষ্ট্র চলবে, হিন্দুর রাষ্ট্র হিন্দু নিয়মে চলবে ইত্যাদি যুক্তিও মেনে নেয়া। কিন্তু এটা গণতান্ত্রিক কোন নীতি হতে পারে না। সংখ্যাগুরু মানুষ ভোট দিয়ে যদি রাজতন্ত্র আনতে চায় তাহলে সেটা আনা যেমন গণতান্ত্রিক হবে না, এটাও তাই।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রথমত ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে। এটা জনগণের কে কতজন কী ধর্ম বিশ্বাস করে বা করে না তার উপর নির্ভর করে না। এমনকি এটা ভোটে নির্ধারণের কোন বিষয়ও নয়। পশ্চিমা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে এখনো শপথের সময় বাইবেল ব্যবহার করা হয়, অথবা রাজা/রাণী রেখে দেয়া হয়েছে এসবের উদাহরণ আরো জঘন্য। ঐসব দেশে এগুলো ঘটছে বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রের কারণে সামন্ততান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রের কিছু কিছু লেজ এখনো রেখে দেবার ফলে। এই যুক্তি দেখিয়ে আমাদের দেশে সংবিধানে ধর্ম ঢুকানোটা পশ্চিমা বুর্জোয়া গণতন্ত্রের নয়, বরং মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিকতার ওকালতী।
সংবিধানের এইরকম ধর্মীয় চেহারা দান এদেশের প্রতিক্রিয়াশীল শাসক বুর্জোয়া শ্রেণীই করেছে তাদের গণবিরোধী চরিত্রের কারণে। জিয়া, এরশাদের ধর্মীয় ভণ্ডামীগুলো হাসিনা আরো পোক্ত করেছে। বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম আর ধর্মনিপেক্ষতা সবগুলো একত্রে রেখে আইনী ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম ভণ্ডামী করেছে বর্তমান সরকার। আর এসবেরই মদদ পেয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদীরা।
হাসিনা ও তার চেলা-চামুণ্ডারা প্রায়ই ধর্মনিরপেক্ষতার এক উদ্ভট সংজ্ঞা দেয়। যখনই ধর্মীয় মৌলবাদীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং এই গণতান্ত্রিক বদমাইশদের কিছুটা রাজনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয় তখনই তারা তারস্বরে বলতে থাকে যে, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়, এর অর্থ হলো সকল ধর্মের প্রতি সমঅধিকার। ফলে আমরা এদের শাসনে দেখতে পাই যে, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানগুলোতে দেশের প্রধান চারটি ধর্মের ধর্মগ্রন্থের পাঠ। মৌলবাদীদের সাথে পার্থক্যটা হচ্ছে, ওরা তথাকথিত ৯০% ভাগের ধর্ম রাষ্ট্রের কাজে রাখতে চায়, আর এরা সবগুলো ধর্মকেই রাখে। আসল মিল হলো এরা সবাই রাষ্ট্রের কাজে ধর্মটা রাখে। এটা কোন ক্রমেই প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক কোন নীতি নয়। এটা হলো এক বদমাইশী বুর্জোয়া ভন্ডামী।
গণতন্ত্রের একমাত্র নীতি হলো রাষ্ট্র থেকে ধর্মের বিচ্ছিন্নতা। তাহলেই রাষ্ট্র মধ্যযুগীয় অবিজ্ঞানের জগত থেকে আধুনিক প্রগতিশীল ইহজাগতিক জগতে প্রবেশ করতে পারে। রাষ্ট্র সর্বক্ষেত্রে আধুনিক জ্ঞান ও বিজ্ঞান দ্বারা চালিত হবে। এটাই হলো গণতান্ত্রিক সমাজের অগ্রগতির ভিত্তি।
এ ধরনের একটি রাষ্ট্রে ধর্ম ব্যক্তি-মানুষের জীবনে থাকবে অথবা থাকবে না, থাকলে সেটা ইসলাম বা অন্য কিছু হবে। পৃথিবীতে ধর্ম শুধু চারটি নয়, অসংখ্য রয়েছে। এমনকি ইসলামেও শত রকমের বিশ্বাস ও ব্যাখ্যা রয়েছে। যে কারণে শিয়া সুন্নি দাঙ্গা হয়, কাদিয়ানীদের খতম করা হয়, বহু ধর্ম-ব্যাখ্যাকারকে এলাকা ছাড়তে হয়। এসব বিশ্বাসের কোনটা নিয়ে আধুনিক রাষ্ট্র চলতে পারে না। আধুনিক রাষ্ট্রে এসব বিশ্বাস পোষণ করা না করাটা মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও অধিকারের বিষয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সেটা অবশ্যই নিশ্চিত করবে, কিন্তু রাষ্ট্রের উপর যেকোন ধর্মের খবরদারী ও অনুপ্রবেশ কঠোরভাবে প্রতিহত ও উচ্ছেদ করবে। এদেশের বুর্জোয়া শাসক শ্রেণী তার প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রের কারণে কখনো তা করেনি। ফলে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ বুর্জোয়া অর্থেও গণতান্ত্রিক হয়ে উঠেনি।
২। অন্য সকল ইসলাম-ধর্মীয় মৌলবাদীদের মত হেফাজতও কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণার দাবী করেছে। নাস্তিকদের মেরে ফেলার বিধান দিচ্ছে। ইসলাম বা বিভিন্ন ধর্মের সমালোচনাকারীদের হত্যা করার স্বাধীনতা চাচ্ছে।
শাসক বুর্জোয়া শ্রেণীর গণতন্ত্রপন্থীরা একে মোকাবেলা করছে এই বলে যে, এগুলো প্রকৃত ইসলাম নয়। অর্থাৎ, তারা যে ব্যাখ্যা দিচ্ছে সেটাই প্রকৃত ইসলাম। এভাবে কে আসল মুসলমান আর কোনটা প্রকৃত ইসলাম এই তর্কে মানুষকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। আর মুখ বন্ধ করা হচ্ছে ধর্ম প্রশ্নে সমালোচকদের। এটা ধর্মীয় মৌলবাদকে শক্তিশালী করা ছাড়া আর কিছু নয়।
কোনটা প্রকৃত ইসলাম আর কোনটা নয়, সে বিতর্ক ধর্মীয় আলেমরা করতে পারে, কিন্তু কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বা রাজনীতি নয়। কাদিয়ানীরা প্রকৃত মুসলিম কিনা সেটা ধর্মীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বিতর্কের কাজ। কিন্তু তারা যখন রাষ্ট্রকে তাদের অমুসলিম ঘোষণা করতে বলে তখন সেটা একটি কাদিয়ানী বিরোধী দাঙ্গা বাধানোর ভিত্তি সৃষ্টি ছাড়া আর কিছু নয়। এটা এক চরম ফ্যাসিবাদী কর্মসূচি। প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কখনই সেটা মানতে পারে না। অথচ হেফাজতীরা ১৩ দফা প্রকাশ করার পর আওয়ামী ঘরানার বুর্জোয়া রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী ও এনজিও-গুলো তাদেরকে কোরান পোড়ানোর যুক্তিতে যতনা বিরোধিতা করছে, তার এক কণা উন্মোচনও করছে না কাদিয়ানী প্রশ্নে এই মৌলবাদী কর্মসূচির ফ্যাসিস্ট চরিত্রকে।
ধর্ম প্রশ্নে যেকোন সমালোচনাকেই আল্লাহ-রসুলের অবমাননা বলা যেতে পারে। ধর্মীয় মৌলবাদীরা যদি কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম বলতে পারে, তাহলে একজন নাস্তিক বা অন্য ধর্মবিশ্বাসীরা কেন এদের ধর্মকে সমালোচনা করতে পারবে না?
অবশ্য ধর্মের সমালোচনা যখন দায়িত্বশীল বিজ্ঞানসম্মত সংগ্রামের বদলে ধর্ম ও ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে বুর্জোয়া কুৎসা-আক্রমণে পরিণত হয়, অথবা তা বিপ্লবী ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগ্রামের সাথে সংযুক্ত না হয়ে প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া রাজনীতিকে সেবা করে, তখন সেগুলো বরং ধর্মীয় প্রবক্তাদের উদ্দেশ্যকেই সেবা করে, ধর্মীয় উন্মাদণাকেই সেবা করে। তাই, প্রকৃত বৈজ্ঞানিক ও প্রগতিবাদী সংগ্রামকে অবশ্যই এ বিষয়টিতে সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে।
যেকোন আধুনিক মানুষের পক্ষেই এটা বোঝা সম্ভব যে, ধর্মবিশ্বাস দ্বারা বর্তমান বিশ্বে কোন রাষ্ট্রই চলতে পারে না। যদি চালাতে হয় তাহলে সেটা হয়ে পড়বে একটি ফ্যাসিবাদী সমাজ, যা কিনা ধর্ম প্রশ্নে শাসকদের ব্র্যান্ডের বাইরে অন্য কোন ভিন্নমতকে সহ্য করবে না। হেফাজতী ও ধর্মীয় মৌলবাদীরা যতই বলুন না যে, তারা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেবেন, কিন্তু সেটা এ রকম একটি ফ্যাসিবাদী সমাজ দিতে সম নয়। কৃষক যখন কোরবানী দেবার জন্য গরু পুষে তখন তাকে যথেষ্ট খাতির যত্ন করা হলেও সেটা সেই গরুর জন্য কোন নিরাপত্তা নয়। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদেরকে মুসলিমরা কেন নিরাপত্তা দেবে? যদি বলা হয় ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা মুসলিমদেরকে নিরাপত্তা দেবে তাহলে কথাটি কেমন শোনাবে? এ ধরনের বক্তব্য উচ্চ ও অধস্তন সম্পর্ককেই প্রকাশ করে। রাষ্ট্র সকল নাগরিককে নিরাপত্তা দেবে সমানভাবে। এটাই গণতান্ত্রিক বিধান। নতুবা নয়।
৩। নারীদের বিষয়ে হেফাজতীরা শালীনতা, হেজাব, ইত্যাদি কথা নিয়ে এসেছে।
সবাই জানে যে, বুর্জোয়া ও সাম্রাজ্যবাদী-সম্প্রসারণবাদী ব্যবস্থাধীনে অন্য সব দেশের মত আমাদের দেশেও নারীকে ও তার দেহকে পণ্য করা হয়েছে। যৌনকে পণ্য করা হয়েছে। এরই ফলশ্রুতিতে দেশে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, নারীর অবমাননা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। কিন্তু এটাই নারীর অবমাননার একমাত্র কারণ নয়। পুঁজিবাদের আগে মধ্যযুগে, ধর্মীয় কর্তৃত্বের যুগে নারীদের উপর নিপীড়ন ও অত্যাচার আদর্শগতভাবেই জারী ছিল। দাসী সম্ভোগ বৈধ ছিল, বহু-স্ত্রী প্রথার মাধ্যমে নারীকে অধস্তন করে রাখা হয়েছিল এবং তার উপর প্রচণ্ড শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ছিল, নারীকে অনেক গোত্রে মানুষও মনে করা হতো না, অনাচারের কারণ হিসেবে নারীকেই দেখা হতো, পতিতালয়ের নরক বৈধ ছিল যা এখনো চলছে, নারীকে শক্তিমান শাসকদের উপঢৌকন হিসেবে দেয়া হতো, বিধবা বিবাহ হতো না, সতীদাহের মত বর্বর প্রথা চালু ছিল, নারীর সম্পদের অধিকার ছিল না বা সমঅধিকার ছিল না, শ্রমের মূল্য ছিল না, যুদ্ধেেত্র দখলকৃত শত্রুসম্পত্তির মধ্যে নারীকেও গণ্য করা হতো, স্ত্রীকে পেটানো বৈধ ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি বহু উদাহরণ দেয়া যাবে।
এগুলোর প্রায় সবই এখনো ব্যাপকভাবে সমাজে রয়েছে। নারী প্রশ্নে হেফাজতের দৃষ্টিভঙ্গি এই মধ্যযুগীয়তারই প্রভাব। এরা পুঁজিবাদের প্রতিক্রিয়াশীলতার কিছু কিছুকে বিরোধিতা করতে চায় মধ্যযুগীয় দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা। নারীকে যদি মানুষ হিসেবে রাষ্ট্র ও সমাজ সম-মর্যাদা দেয় তাহলে নারী পুরুষ উভয়েই নারীর নিরাপত্তা ও শালীনতা রক্ষা করবে। হেফাজতীরা একদিকে হিজাবে উদ্বুদ্ধকরণের কথা বলেছে, অন্যদিকে ইসলামে হিজাব বাধ্যতামূলক সেটাও বলেছে। তারা পুরুষকে ঢেকে রাখার কথা বলছে না কেন? পুরুষ কি আকর্ষণীয় নয়, নারীর কাছে? তাদের মধ্যযুগীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীকে দেখাই হচ্ছে পাপের উৎস হিসেবে। তাদের বর্ণিত শালীনতার সংজ্ঞা কী? তারা পোষাককে বানাতে চায় অন্তর্বাস, বিপরীতে পুঁজিবাদ অন্তর্বাসকে বানিয়েছে পোশাক। কোনটাই স্বাভাবিক নয়। পুরুষ ও নারীর নিজ নিজ শারীরিক বৈশিষ্ট রয়েছে। সে অনুযায়ী সুস্থ সংস্কৃতিবান ও প্রগতিশীল মানুষ পোশাক পরবে। যা আবার সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল। কাজের বৈশিষ্ট অনুযায়ী বিচিত্র। এইসব ধর্মীয় মৌলবাদীরা কীভাবে আশা করেন যে, হিজাব পরে গ্রামের কৃষক নারী, বা শহরের নির্মাণ শ্রমিক নারীরা তাদের পেশাগত কাজ করবেন; ফুটবল খেলবেন, দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেবেন বা সাঁতার কাটবেন?
তারা সুস্পষ্টভাবে সম্পদে নারী-পুরুষের সমঅধিকারকে বিরোধিতা করছে। একেক ধর্মে পৈত্রিক সম্পত্তি বন্টনের একেক বিধান রয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল রাষ্ট্র এ সম্পদে নারী-পুরুষের সমঅধিকার না দিলে সেটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হতে পারে না। আওয়ামী প্রতিক্রিয়াশীল নারী নীতি ও শিক্ষা নীতিকে তারা বিরোধিতা করছে পশ্চাদপদ জায়গা থেকে। আমরা তার বিরোধিতা করি বিপরীত জায়গা থেকে। ধর্মীয় মৌলবাদীদের আপত্তির মুখে বহু আগেই আওয়ামী সরকার ঘোষণা করেছিল যে, ইসলামের বিরোধী হলে কোন নীতিই কার্যকর হবে না। এভাবে হাসিনা সরকার জঘন্যভাবে মৌলবাদের কাছে নতিস্বীকার করেছে।
৪। প্রাণীর ভাস্কর্য করা যাবে না, কারণ ইসলামে বারণ রয়েছে। বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে, গাছেরও প্রাণ আছে। সেখানে মৌলবাদীরা কী করবে? নবী মোহম্মদের ছবি আঁকা যাবে না, কারণ ধর্মে বারণ রয়েছে। কিন্তু আজ হজ্জ করতেও ছবি লাগে। মানুষের ছবি তোলা ও ছাপানো, টেলিভিশনের ছবি এসবকে মৌলবাদীরা মেনে নিচ্ছে কোন ধর্মীয় বিধান মতে? এমনকি তারাও ধর্মীয় বিধানকে যুগের সাথে সাথে কিছুটা বদলে নিতে বাধ্য হচ্ছে না কি?
* প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আধুনিক বিজ্ঞান ও মূল্যবোধ দ্বারা চলতে বাধ্য। আমাদের শাসক বুর্জোয়া শ্রেণী ও তাদের রাষ্ট্র প্রতি পদে পদে দুই নৌকায় পা দিয়ে চলেছে। এর কারণ হলো যেমন হেফাজতী কর্মসূচিতে, তেমনি আওয়ামী-বিএনপিসহ সকল বুর্জোয়া পার্টির কর্মসূচিতে দেশের ৯০% যে জনগণ সেই শ্রমিক, কৃষক, দরিদ্র ও সাধারণ মধ্যবিত্ত জনগণের জীবনের অসংখ্য সমস্যার কোন উল্লেখই নেই। তার কোন আলোচনা তারা কেউই করে না। এ ব্যবস্থার আমূল রূপান্তরের প্রশ্ন-তো একেবারেই অবান্তর। বাস্তবে ৯০% জনগণের সেই প্রকৃত কর্মসূচিকে ধামাচাপা দেবার জন্যই এইসব বুর্জোয়া-সামন্ততান্ত্রিক কর্মসূচি তোলা হয়, তার উপর কাইজ্যা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা হয় এবং জনগণকে বিভ্রান্ত করে বিভক্ত করে সেসবের পিছনেই লেলিয়ে দেয়া হয়। এগুলো হলো বিদ্যমান প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখবারই বিভিন্ন কর্মসূচি। এসব গণবিরোধী রাজনীতিরই পরিণতি হলো মৌলবাদী উত্থান।
* হাসিনা সরকার নিজেকে বেশী মুসলমান ও প্রকৃত মুসলমান দেখাতে চায়। আর পদে পদে মৌলবাদীদের সাথে আপোষ করে। কারণ, তাদের নিজেদের চরিত্র প্রগতিশীলও নয়, গণতান্ত্রিকও নয়। আজ মৌলবাদের হুজুগে নিজেদের রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হওয়ায় তারা মৌলবাদ বিরোধিতার কথা বলছে। মৌলবাদীদেরকে ধর্ম-ব্যবসায়ী বলছে। কিন্তু ধর্ম-ব্যবসায়ী তো সে, যে কিনা প্রতারণার সাথে ধর্মকে ব্যবহার করে। সেটা-যে এদেশের গণশত্রু বুর্জোয়া শাসক শ্রেণী সেটা বিগত ৪২ বছরেই পরিস্কার হয়ে গেছে। যাদের প্রধান প্রতিনিধিত্ব এখন হাসিনা-আওয়ামী লীগ করছে। ৫ মে’র ঘটনার পর সরকারী ও আওয়ামী দলগুলোই শুধু নয়, ভন্ড বাম ও এনজিও নারী সংগঠনগুলোও হেফাজতীদের (এবং তার সূত্র ধরে জামাত ও বিএনপি’র) বিরুদ্ধে যে প্রচার অভিযান চালাচ্ছে তার কেন্দ্র বিন্দু হলো কোরান পোড়ানোর বিষয়। কে কত বেশি কোরান ও ইসলামের সেবক ও অনুসারী তারই যেন প্রতিযোগিতা চলছে। রাজনৈতিক ও আদর্শগতভাবে মৌলবাদকে সংগ্রাম না করে এই ধর্ম-ব্যবসা ও প্রতারণা মৌলবাদকে পুনরায় শক্তিই যোগাচ্ছে মাত্র।
তারা অনেকে মৌলবাদীদেরকে সংগ্রামের ক্ষেত্রে ’৭১-এর চেতনার কথা বলে থাকে। বিশেষত ভণ্ড বাম ও নারী এনজিও-গুলো। এর মাধ্যমে বাস্তবে তারা ’৭১-এর আওয়ামী প্রতিক্রিয়াশীল চেতনার সাফাই গায়। সেই চেতনায় যদি মৌলবাদীদের প্রকৃত কোন সংগ্রামই করা যেতো তাহলে তাদের সৃষ্ট ও বিগত ৪২ বছর ধরে তাদের দ্বারা চালিত এ বাংলাদেশে মৌলবাদীরা এতটা শক্তি নিয়ে কখনই আসতে পারতো না।
এই শাসক পার্টিগুলো, বুর্জোয়া শ্রেণী ও তাদের রাষ্ট্র দেশজুড়ে ৯০ হাজার মাদ্রাসা বানিয়ে রেখেছে, পীরবাদীদের রমরমা চলছে যা প্রতিটি বুর্জোয়া পার্টি মদদ দিয়েছে, ২ লক্ষ মসজিদকে সরকারী সাহায্যে চালানো হচ্ছে। এভাবে রাষ্ট্র থেকে শাসক বুর্জোয়া শ্রেণী ধর্মীয় মৌলবাদ উদ্ভবের এক অতি শক্তিশালী ভিত্তি দিয়েছে, যা যেকোন বুর্জোয়া দল ও প্রতিষ্ঠান থেকে শক্তিশালী আদর্শগতভাবে, সাংগঠনিকভাবে ও আয়তনে। এরই একটা অংশের প্রকাশ ঘটছে হেফাজতের আন্দোলনে। এটা এই ব্যবস্থারই অংশ, হঠাৎ করে এই মৌলবাদ সৃষ্টি হয়নি। এর জন্য শাসক বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিটি বুর্জোয়া পার্টি ও এই রাষ্ট্র দায়ী।
* ধর্মীয় মৌলবাদীদের এই উত্থানের সাথে বিশ্ব পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। নিকট অতীতে বিশ্বব্যাপী মুসলিম মৌলবাদী উত্থান ঘটেছিল মার্কিনের মদদ, প্রশ্রয় ও আশ্রয়ে যখন তারা প্রতিদ্বন্দ্বী সাম্রাজ্যবাদ সোভিয়েতকে মোকাবিলার জন্য আফগানিস্তান-পাকিস্তানে তাদের সৃষ্টি করেছিল। পরবর্তীকালে আফগানিস্তান, ইরাক, এখন লিবিয়া, সিরিয়ায় আগ্রাসনের ফলে সেসব দেশে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন বিরোধিতা আশ্রয় নেয় ইসলাম ধর্মীয় মৌলবাদে। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রকৃত ও একমাত্র প্রগতিশীল শক্তি কমিউনিজমের চলমান সংকটের কারণে এর উদ্ভব অনিবার্য হয়ে উঠেছে। মৌলবাদী উত্থানকে পরাজিত করার একমাত্র উপায় হলো বিশ্বব্যাপী কমিউনিজমের আদর্শকে পুনর্জাগরিত করা, যা কিনা প্রগতিশীল ভিত্তিতে সাম্রাজ্যবাদ ও আমাদের দেশগুলোতে দালাল প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়াদের বিরোধিতা ও উচ্ছেদ করতে পারে। প্রকৃত সমাজতান্ত্রিক/কমিউনিস্ট আন্দোলন ব্যতীত ধর্মীয় মৌলবাদ প্রতিহত করার আর কোন পথ নেই।
উদ্ধৃতি
“ধর্ম নিয়ে রাষ্ট্রের কোন গরজ থাকা চলবে না এবং ধর্মীয় সংস্থাসমূহের রাষ্ট্রীয় মতার সঙ্গে জড়িত হওয়া চলবে না। যেকোন ধর্মে বিশ্বাস অথবা কোন ধর্মই না মানায় (অর্থাৎ নাস্তিক হওয়া যেমন প্রতিটি সমাজতন্ত্রী) সকলেই থাকবে সম্পূর্ণ স্বাধীন। ধর্মবিশ্বাসের জন্য নাগরিকদের অধিকারে কোন প্রকার বৈষম্য কোনক্রমেই সহ্য করা হবে না। এমনকি সরকারী নথিপত্রে যেকোন নাগরিকের ধর্মের উল্লেখমাত্রও প্রশ্নাতীতভাবে বর্জিত হবে। রাষ্ট্রানুমোদিত গির্জাকে কোন অর্থমঞ্জুরী অথবা ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক সংস্থাকে কোন প্রকার সরকারী বৃত্তিদান করা চলবে না। এগুলোকে হতে হবে সমমনোভাবাপন্ন ব্যক্তিদের সম্পূর্ণ স্বাধীন, সরকারী সংশ্রব-বর্জিত প্রতিষ্ঠান।”
“ধর্মীয় প্রশ্নকে বিমূর্ত, আদর্শবাদী কায়দায়, শ্রেণীসংগ্রামের সঙ্গে সম্পর্কহীন ‘বুদ্ধিবাদী’ প্রসঙ্গ রূপে উপস্থাপিত করার বিভ্রান্তিতে আমরা কোন অবস্থাতেই পা দেব না, বুর্জোয়াদের র্যাডিকেল ডেমোক্রেটগণ প্রায়ই যা উপস্থাপিত করে থাকে।………পুঁজিতন্ত্রের তামস শক্তির বিরুদ্ধে স্বীয় সংগ্রামের মাধ্যমে চেতনালাভ ব্যতীত যেকোন সংখ্যক কেতাব, কোন প্রচারে প্রলেতারিয়েতকে আলোকপ্রাপ্ত করা সম্ভব নয়। ………..আমরা সব সময়ই বৈজ্ঞানিক বিশ্ববীক্ষা প্রচার করব, নানাবিধ ‘খৃষ্টানের’ অসঙ্গতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম আমাদের প্রয়োজন। এর অর্থ মোটেই এই নয় যে, ধর্মের প্রশ্নকে আমাদের সর্বাধিক প্রাধান্য দেয়া উচিত, যা তার প্রাপ্য নয়।” লেনিন, ‘সমাজতন্ত্র ও ধর্ম’, ডিসেম্বর, ১৯০৫।