বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্তমানে শিল্প হিসেবে সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর গার্মেন্ট শিল্পের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিগত প্রায় তিন দশক ধরে গড়ে ওঠা রফতানি আয়ের ৮০ ভাগই আসে এ খাত হতে। এ সেক্টরে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। যার ৮০ ভাগ অর্থাৎ ৩০-৩২ লাখই নারী শ্রমিক। এ শিল্পের এত দ্রুত বিকশিত হওয়ার অন্যতম কারণ এ দেশীয় সস্তা শ্রম বাজার। এ দেশের অর্থনীতির বিগত কয়েক দশক ধরে কৃষিতে সাম্রাজ্যবাদী অনুপ্রবেশের ফলে গ্রামীণ জনজীবনে এক ভয়াবহ সংকটের তৈরি হয়। এনজিও ও মহাজনী সুদে জর্জরিত, ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত, জমিহারা নিঃস্ব-প্রায় কৃষক উদ্ধাস্তুর মতই ঠাঁই নেয় শহরের ঘিঞ্চিতে। জীবন বাঁচাতে এদের অধিকাংশই আশ্রয় নেয় গার্মেন্টসহ বিভিন্ন শিল্প ক্ষেত্রে ও নানা শ্রমশোষণমূলক পেশায়। সহজলভ্য ও কোন কারিগরী দতা ছাড়াই গ্রাম থেকে আগত নারীদের এক বড় অংশ অত্যন্ত স্বল্প মজুরীতে (ন্যূনতম ২৫০০ টাকায়) গার্মেন্ট শ্রমিক হিসেবে যোগ দেয়। যাদের অধিকাংশের বয়স ১৫-২৫ বছর। অধিক শ্রম সময় ( ১২-১৮ ঘন্টা), নামমাত্র ছুটি-ছাটা, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির তুলনায় স্বল্প মজুরীতে শ্রমিকেরা এক দূর্বিসহ জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। পাশাপাশি কথায় কথায় চাকরী ছাঁটাই, ওভারটাইম মেরে দেয়া, দেরীতে বেতন দেবার মাধ্যমে নিয়মিতভাবে মজুরীর একটা অংশ আত্মসাৎ করা, নারী শ্রমিকদের সাথে অপমাননাকর আচরণ, মালিকদের পোষা বাহিনী কর্তৃক মারপিট-নির্যাতন কার্যত শ্রমিকদের অবস্থা ১৯ শতকের ইউরোপের শ্রমিক শ্রেণীর ন্যায় মজুরী দাসেরই জীবন। শ্রমিকদের এ পুঞ্জিভূত ক্ষোভ মাঝে মাঝেই বকেয়া বেতন, ন্যায্য মজুরী ও নানা ধরনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিষ্ফোরিত হয়ে উঠলে তার উপর নেমে আসে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নির্যাতন।
এমনতর নির্মম শাসন-শোষণে জর্জরিত শ্রমিকদের স্বাভাবিক মৃত্যুও আজ অনিশ্চয়তার মুখে পতিত। ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজার ধ্বংস্তুপ তার নির্মম সাক্ষী। সরকারী হিসেব মতই মৃত্যুর সংখ্যা ১১২৬ জন (যে হিসেব প্রায়ই মিথ্যা হয়)। পঙ্গুত্ববরণকারীদের সংখ্যা অসংখ্য, আর নিখোঁজদের খোঁজে এখনও শত শত মানুষ ভীড় করছে রানা প্লাজা নামক মৃত্যুকুপে। ঘটনা পরবর্তী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গাঁজাখুরী গল্প , প্রধানমন্ত্রীর মিথ্যাচার এ ট্র্যাজেডির নায়ক ভবন মালিক যুবলীগ নেতা সোহেল রানা, তার গডফাদার সংসদ সদস্য মুরাদ জং ও গার্মেন্ট মালিকদের বাঁচাতে শাসক শ্রেণী, সরকার যে কতটা মরিয়া তারই প্রমাণ বহন করে। পুর্বেও মালিকদের গাফিলতির কারণে তাজরীন, হামীম, স্পোকট্রামসহ অসংখ্য গার্মেন্টে এ ধরনের হত্যাকান্ড ঘটেছে। মুনাফাখোর মালিকদের কারখানায় অব্যবস্থাপনার বলি হতে হয়েছে হাজার হাজার শ্রমিকের। ১৯ বিলিয়ন ডলার রফতানি খাতের এ শিল্প হতে কয়েক দশকে হাজার হাজার মালিক বনে যাওয়া উদ্যোক্তাদের কাছে শ্রমিকের জীবন পুরোপুরিই মূল্যহীন। একের পর এক ঘটে যাওয়া এ ধরনের ঘটনার পরও রাষ্ট্র সরকার নির্বিকার। এযাবৎ কোন হত্যাকান্ডের বিচার হয়নি। এমনকি নিহত-আহতদের উপযুক্ত তিপূরণের ব্যবস্থাও করেনি। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মন্ত্রি সাংসদদের বিরাট অংশই গার্মেন্ট মালিক। অন্যান্য মালিকরাও শাসক শ্রেণীর কোন না কোন অংশের ছত্রছায়ায় লালিত-পালিত।
বিশ্ববাজারে পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ ২য় অবস্থানে আছে। যার সিংহভাগ ক্রেতাই পশ্চিমা বিশ্বের বিখ্যাত সব পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। গত ১ বছরে বাংলাদেশের গার্মেন্টস রপ্তানীর ২৩ ভাগই গেছে আমেরিকা এবং ৬০ ভাগ ইউরোপে। জগত বিখ্যাত ওয়ালমার্ট, ডিজনী, এইচ এন্ড এমসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকাকে সস্তা শ্রমের বাজার হিসেবে বেছে নেয়। সুঁই-সুতা যন্ত্রপাতি, খুচরা যন্ত্রাংশ, গার্মেন্ট এক্সেসারিজ পাশ্চাত্যে তেরি হলেও তারা টেইলারিং শপ হিসেবে এ মহাদেশগুলোকে বেছে নেয়। তদুপরি বাংলাদেশ সস্তা শ্রমের জন্য অন্যতম। মূলতঃ সস্তা শ্রমের ফলেই বহুজাতিক কোম্পানীগুলো পাকটস্থ করে শ্রমিকের উদ্বৃত্ত শ্রমের সিংহভাগ। মার্কিন মানবাধিকার সংস্থার মতে নিউইয়র্কে যে দামে বাংলাদেশের পোশাক বিক্রি হয় তার ৬০ ভাগ পায় বিদেশী বায়ার ও ব্রান্ড বিক্রেতারা। বাকী ৪০ ভাগের মধ্যে উৎপাদন ও পরিবহন খরচসহ দেশীয় মালিকদের মুনাফা অন্তর্ভুক্ত। শ্রমিকের মজুরী সেখানে শতকরা ১ ভাগ।
পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের মুনাফার যাঁতাকলে পিষ্ট আজ শ্রমিকরা, অকাল মৃত্যু অহরহ। মুনাফা, শুধুমাত্র অধিক মুনাফার লোভে লিপ্ত বিশ্বখ্যাত ব্রান্ড থেকে শুরু করে এ দেশীয় মালিকরা। অসীম মুনাফা-ক্ষুধা এদের। রানা প্লাজা-তাজরীনসহ অসংখ্য গার্মেন্টে এ সব মর্মান্তিক হত্যাকান্ড পরবর্তী বহুজাতিক ব্র্যান্ডদের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার হুমকি শুধুই কুম্ভিরাশ্রু বর্ষণ। এটা তারা করছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রগতিশীল মহলে এমনকি বুর্জোয়া মিডিয়াতেও ব্যাপক লেখালেখি, সমালোচনার ফলে। বিজিএমইএ বা সরকারের আশ্বাস-প্রশ্বাস সবই প্রতারণা। আজও নিহত-নিখোঁজদের পূর্ণ তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। আহতদের চিকিৎসা নিয়ে চলছে বিড়ম্বনা। কিছু সংখ্যক নিহতের পরিবারকে দেয়া হচ্ছে নামমাত্র ক্ষতিপূরণ। শ্রমিকদের নিরাপত্তা, পরিবেশ, বকেয়া মজুরী এবং মজুরী বৃদ্ধির ন্যায্য আন্দোলনকে সরকার বরাবরের মতই রাষ্ট্রীয় বাহিনী লেলিয়ে নির্মমভাবে দমন করছে। মালিকরা শত শত শ্রমিক ছাঁটাই করছে, কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছে। এই সবই চলছে সাভার হত্যাকান্ডের পরও। শ্রমিকদের শাসন-শোষণ নিপীড়ন-হত্যার সাথে অচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত মালিক-সরকার-রাষ্ট্র এবং সাম্রাজ্যবাদীরা।
আজকে সরকার বলছে শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধি করবে এর জন্য বোর্ডও গঠন করা হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ, সরকার মালিকরা মিলে কিছু মজুরী হয়ত বৃদ্ধি করবে। তাতে শ্রমিকের সমস্যার তেমন কোন সমাধান হবে না। মজুরী বৃদ্ধির সাথে সাথেই বাড়ী ভাড়া, পরিবহন ভাড়া, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাবে হু হু করে। শ্রমিক শ্রেণী যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই থেকে যাবেন। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থায় শ্রমিক শোষণ করে অতি মুনাফার এটাই নীতি। মালিকরা শ্রমিকদের ভয় দেখায় এই বলে যে, বিদেশীরা কারখানায় কাজ না দিলে শ্রমিকরা বেকার হয়ে না খেয়ে মরবে। অর্থাৎ আন্দোলন সংগ্রাম করো না, যা মজুরী দেয়া হয় তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাক। শিল্প-কারখানা এবং কৃষি ব্যবস্থা অর্থাৎ উৎপাদন ব্যবস্থা সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর রেখে শ্রমিক ও শ্রমজীবী জনগণের দুর্বিসহ জীবনের অবসান কখনই হতে পারে না। সাম্রাজ্যবাদ ও দালাল আমলা-মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া শ্রেণীকে রাষ্ট্রের শাসন মতা থেকে উচ্ছেদ করে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক-দরিদ্র ও মধ্যবিত্তদের গণমতার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সাম্রাজ্যবাদমুক্ত আত্মনির্ভরশীলতার ভিত্তিতে, কৃষিকে ভিত্তি করে, প্রথমতঃ ছোট ছোট শিল্প-কারখানা এবং পর্যায়ক্রমে ভারী শিল্প গড়তে হবে। উৎপাদন ও বন্টনের সামাজিক মালিকানার মধ্য দিয়েই শ্রমিক শ্রেণী ও শ্রমজীবী জনগণের দুর্বিসহ জীবনের অবসান হবে। এর জন্য প্রয়োজন সমাজতন্ত্রমুখী প্রকৃত গণতান্ত্রিক বিপ্লব। এই বিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে হবে মার্কবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদের আদর্শে সজ্জিত শ্রমিক শ্রেণীকেই। তাই, শ্রমিক শ্রেণীকে দাবী-দাওয়ার আন্দোলনে সীমাবদ্ধ না থেকে বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য মুনফা ও ব্যক্তি মালিকানা ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এগিয়ে আসতে হবে। শোষণ-নিপীড়ন এবং শ্রম দাসত্ব থেকে শ্রমিকের মুক্তির এটাই পথ।
-
সাম্প্রতিক লেখা
সংগ্রহ
বিষয়
-
Join 6 other subscribers
Top Clicks
- None