পদ্মা সেতুসহ সরকারের বিভিন্ন খাতে দুর্নীতি সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থারই বিষবাষ্প

সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী মহাজোটের দুর্নীতির নানাবিধ খণ্ডচিত্র একের পর এক জনসম্মুখে প্রকাশ পাওয়ায় সরকারের গণবিরোধী ও দেশবিরোধী কার্যকলাপ জনগণ আরও একবার প্রত্যক্ষ করল। গলাবাজী করা মন্ত্রী-আমলাদের ঘুষ-দুর্নীতি হাতেনাতে ধরা পড়ায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে সরকার। বিশেষত দুর্নীতির দায়ে পদ্মাসেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ঋণ স্থগিত, রেলের নিয়োগ বাণিজ্য, সোনালী ব্যাংক হতে হলমার্কের অর্থ জালিয়াতির ঘটনা, শেয়ার মার্কেটের কেলেঙ্কারী আকণ্ঠ নিমজ্জিত দুর্নীতিগ্রস্থ সরকারের নমুনামাত্র।
রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত বাবু নিয়োগ বাণিজ্যের অর্থ কেলেঙ্কারীর দায়ে পদত্যাগ করেছেন। যিনি কিনা রেলকে দুর্নীতিমুক্ত করার খড়গহস্ত ধারণ করে এবং এ শাখায় দুর্নীতিবাজদের কালো বিড়াল বলে অভিহিত করেছিলেন। পরবর্তীতে তার বর্ণিত চরিত্রে নিজেই নিজেকে অলংকৃত করেন। পাশাপাশি সোনালী ব্যাংক হতে হলমার্কের প্রায় ৪,০০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং পরবর্তীতে অর্থমন্ত্রীর নগ্ন সাফাই এ বিপুল পরিমাণ অর্থকে সামান্য বলায় সরকারের মন্ত্রী-আমলাদের এ দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ততারই জ্বলন্ত প্রমাণ বহন করে।
তবে সরকারকে সবচেয়ে বেশি নাজেহাল করেছে পদ্মাসেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংক। মহাজোট সরকার, প্রধান মন্ত্রী পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয়নি বলে প্রথম দিকে গলাবাজী করে মন্ত্রী-উপদেষ্টাকে বাঁচানোর অপচেষ্টা করে। বিশ্বব্যাংককে দায়ী করে ক্ষতিপূরণ দাবি করে সংসদে। জনগণের পয়সায় সেতু বানানোর বাগাড়ম্বর করে। শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের চোখ রাঙানীতে অপসারিত হয়েছে যোগাযোগমন্ত্রি আবুল হোসেন। প্রধান মন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা মশিউরকে ছুটিতে পাঠাতে বাধ্য হয়েছে সরকার। বিশ্বব্যাংকের পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থ ছাড় নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনার সাথে তার অফিসে সাক্ষাৎ করেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পরবর্তীতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তাঁর দেশ পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের সাথে কথা বলবে। একই সময়ে অর্থমন্ত্রী জানান, বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্র জাপান, যুক্তরাজ্য, ভারত পদ্মা সেতুর অর্থ ছাড়ের ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের সাথে আলোচনা চালাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ এই প্রকল্পে দুর্নীতি হচ্ছে। বিশ্বব্যংকসহ বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থাগুলো তাদের স্বার্থের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ প্রকল্পে অর্থলগ্নী করে। এ জন্য বিশ্বব্যাংক তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতা ও বড় বড় আমলাদের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে। যা খোদ বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতিগ্রস্ততারই পরিচয় বহন করে। দুর্নীতি হচ্ছে বিশ্বায়ন অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থার একটা অংশ। যা বিশ্বব্যাংকের নিজেরও বৈশিষ্ট্য। প্রধানমন্ত্রী ৪ জুলাই, ’১২ সংসদে দাঁড়িয়ে বিশ্বব্যাংককে ইঙ্গিত করে অভিযোগ করে ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও ফোবর্স ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন পড়ে দেখা হোক, তা হলেই দুর্নীতি কোথায় আছে তা জানা যাবে।” তৃতীয় বিশ্বের বাংলাদেশের মত দেশগুলোর সরকারের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্পের দায়মুক্তি অধ্যাদেশ, বিশ্বব্যাংক তাদের রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহার করে। পরবর্তীতে কেউ যেন তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে কথা বলতে না পারে।
তাই, পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যংকের এই সাধুপনা তার দুর্নীতি-বিরোধী চরিত্র নয়, বরং বিবিধ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থে সরকারের উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে আরও বড় স্বার্থ বাগিয়ে নেয়ারই কৌশল। এর পিছনে অবশ্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাত আছে। এবং কেনা জানে বিশ্বব্যাংকের মূল নিয়ন্ত্রণ ভার মার্কিনীদের হাতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট সবুজ সংকেত দিলে বহুপূর্বেই বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতুর জন্য অর্থ ছাড় করত। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ ও আমেরিকার মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে “অংশীদারিত্বের সংলাপ” চুক্তি। রাষ্ট্রীয়ভাবে চুক্তির বিষয়ে নীরবতা পালন করলেও ইন্ডিয়ান টিভি টাইমস নাও খবর দিয়েছে হিলারী ঢাকার সাথে বঙ্গোপসাগরে ৭ম নৌবহরের ঘাঁটি করার চুক্তি করেছে।
এই সব নানাবিধ কারণে পর্দার আড়ালে দরকষাকষি চলছিল। সরকার সকল শর্ত মেনে নেয়ায় এ প্রকল্পে অর্থায়নে পুনরায় এগুতে চাচ্ছে বিশ্বব্যাংক। আবুল-মশিউরকে ছাঁটাইয়ের পর বিশেষ শর্তগুলো হচ্ছে দুদক দুর্নীতির যে তদন্ত করবে তার তথ্য বিশ্বব্যাংকের প্যানেলের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। সেই রিপোর্ট যদি বিশ্বব্যাংকের পছন্দ হয় তবেই তারা অর্থ ছাড় করবে। এ ছাড়াও ক্রয়সংক্রান্ত সব কাজ বিশ্বব্যাংকের ভাষায় স্বচ্ছ হতে হবে। নইলে তারা ডলার ছাড় করবে না। অর্থাৎ সব কিছুই বিশ্বব্যাংকের নির্দেশ মত করতে হবে। এই সব শর্ত মেনে নেয়া একটি স্বাধীন দেশ ও জাতির পরিচায়ক নয়। আমাদের দেশের শাসক শ্রেণী বিশ্বব্যাংকের পায়ের ওপর গড়াগড়ি খাওয়ার মধ্য দিয়ে তাদের এই দেশদ্রোহীতারই প্রমাণ দিচ্ছে।
বিরোধীদল সরকারের এ লেজেগোবরে অবস্থা বা দুর্নীতির কথা বলে নির্বাচনী ফায়দা লুটার চেষ্টা করলেও বিগত দিনে তারাও ছিল একই দোষে দুষ্ট। বি.এন.পি.’র নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট সরকার দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ছিল। আজকের আওয়ামী মহাজোট সরকারের ঘুষ-দুর্নীতি লুটপাট দুর্নীতির চ্যাম্পিয়শীপ অর্জনে বিরোধী দলের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছে।
সরকার বা শাসক শ্রেণীর এ দূর্নীতি বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয় । সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ মানেই শোষণ-লুটপাট-দুর্নীতি। আজকের সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিও গড়ে উঠেছিল ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ লুটপাটের মাধ্যমে। নয়া ঔপনিবেশিক যুগে বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশের শাসক শ্রেণী একদিকে সাম্রাজ্যবাদী কমিশন, পাশাপাশি জনগণের উপর শাসন-শোষণের মাধ্যমে বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছে।
তাই দুর্নীতি-শোষণ-লুটপাট থেকে সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদের এ দেশীয় সেবাদাস দালাল শাসক শ্রেণীকে উৎখাত করার ও গণক্ষমতা প্রতিষ্ঠার বিপ্লবী রাজনীতিই জনগণের মুক্তির একমাত্র পথ।

About andolonpotrika

আন্দোলন বুলেটিনটি হলো বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন ও বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের একটি অনিয়মিত মুখপত্র
This entry was posted in আন্দোলন ১৩. Bookmark the permalink.

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s