আগুনে পুড়িয়ে, গুলি করে শ্রমিক হত্যার জন্য মালিক ও দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি বিধান শ্রম আইনে নেই

গার্মেন্টস ব্যবসার শুরু থেকে এ পর্যন্ত আগুনে পুড়ে প্রায় ৭০০ শ্রমিক এবং আগুনে পুড়ে, ভবন ধ্বসে বুর্জোয়া বাহিনীর গুলিতে ও অন্যবিধভাবে প্রায় দুই হাজার শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটলেও মালিকসহ দায়ী ব্যক্তিদের কোনো শাস্তি এ পর্যন্ত রাষ্ট্র ও কোনো সরকারই করেনি।
বাংলাদেশের কারখানা নিয়ন্ত্রিত হয় পাকিস্তান আমলের আইন ১৯৬৫ অনুসারে। এ আইনের সেকশন ৯৩ অনুসারে অগ্নিনির্বাপণ ও সতর্কতামূলক যে সব বিধান আছে সেগুলো ভঙ্গ করলে কারখানা মালিক এবং ব্যবস্থাপক উভয়কে মাত্র সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে। যদি একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার আইন ভঙ্গ করে সঙ্গে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড প্রদান করা যেতে পারে। এই আইনের সেকশন ২২-এ অগ্নি প্রতিরোধ এবং এ সংক্রান্ত সতর্কতার বিধান রয়েছে। এই সেকশনের আর্টিকেল ১ও ৬-এ অগ্নিকাণ্ডের সময় বহির্গমনের জন্য প্রশস্ত পথের ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছে। আর্টিকেল ৩-এ বলা হয়েছে কারখানায় যতক্ষণ কাজ চলবে এবং যতক্ষণ একজন শ্রমিকও থাকবেন ততক্ষণ কোনো দরজা বা পথ বন্ধ রাখা যাবে না। আর্টিকেল ৫-এ আগুন লাগার ঘটনায় শ্রবণযোগ্য সতর্কবার্তা বা ফায়ার এ্যালার্মের ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছে।
শ্রম আইন ভঙ্গ করলে এক হাজার টাকা জরিমানার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আইন ভঙ্গের কারণে যদি কোনো শ্রমিকের মৃত্যু হয় তার শাস্তির বিষয়ে কোনো কথা নেই এই বুর্জোয়া আইনে। মাত্র এক হাজার টাকা জরিমানার বিধান থাকার কারণেই মালিকরা এই আইনের তোয়াক্কা করছে না। আর এই আইন কার্যকরী করার জন্য সরকারের কোন কার্যকরী ব্যবস্থাও নেই। ঢাকার ১৫ হাজার কারখানার জন্য শ্রম মন্ত্রণালয়ের কারখানা পরিদর্শনের জন্য মাত্র ৩ জন পরিদর্শক রয়েছে। তা যে কার্যকরী হচ্ছে না তা বলাই বাহুল্য। অথচ শ্রমিক দমনের জন্য রঙ-বেরঙের বাহিনী থাকা সত্ত্বেও ৩ হাজার শিল্প-পুলিশ গঠন করেছে এবং তার জন্য অর্থও যোগান দিচ্ছে সরকার। কিন্তু শ্রমিক স্বার্থ রক্ষার জন্য বুর্জোয়া আইনে স্বীকৃত বিষয়গুলো কার্যকরী করার ব্যবস্থা কোনো সরকারই নেয়নি। ১৯৬৫ সালের তৈরি আইন আপগ্রেড করার কোনো উদ্যোগও সরকারের নেই।
২০০৬ সালের ২৩ ফেব্র“য়ারি চট্টগ্রামের কেটিএস গার্মেন্টে আগুনে পুড়ে সরকারী হিসেব মতে ৫৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। দুই মাস পর ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে সঠিক অভিযোগ দাখিল করেনি। ফল কারখানার দুই পরিচালক এক ম্যানেজারকে জনপ্রতি ১ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করে খালাস দেয় কোর্ট। ২০১০ সালের ফেব্র“য়ারিতে গরীব এ্যাণ্ড গরীব গার্মেন্টে অগ্নিকাণ্ডে ২১ জন শ্রমিক নিহত হলে সরকারী তদন্ত কমিটি মালিকপক্ষকে দোষি সাব্যস্ত করে রিপোর্ট দেয়। কিন্তু মালিকপক্ষকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়নি সরকার। মুনাফার লোভ, সরকারের দায়িত্বহীনতার কারণে এ পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার শ্রমিকের মৃত্যু হলেও কারো কোনো শাস্তি হয়নি।
১৬/৪/’১২-এ খবরে প্রকাশ শ্রম আইনে ২০০৬-এর সংশোধনী খসড়ায় শিল্প মালিকদের ‘সম্মান’ রক্ষায় কারাদণ্ডের প্রস্তাব বাতিল করেছে আইন মন্ত্রণালয়। কারখানার মোট লাভের শতকরা ৫ ভাগ শ্রমিক ভোগ করবে বুর্জোয়া আইনে এ বিধান রয়েছে। কিন্তু এই টাকা মালিকেরা শোষণ করে খেলেও কোনো শাস্তির বিধান নেই। এই টাকা মালিকদের দিতে বাধ্য করার জন্য ছয় মাস জেলসহ শাস্তির প্রস্তাব করা হয়েছিল শ্রম আইন ২০০৬-এর সংশোধনীর খসড়ায়। কিন্তু মালিকদের চাপে সে কারাদণ্ডের প্রস্তাব বাতিল করা হয়েছে। সংশোধনীর খসড়া আইন মন্ত্রণালয় ছাড়পত্র দিয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় যে সংশোধিত আইনটির কপি পাঠিয়েছে তাতে কোনো জেল বা কারাদণ্ডের উল্লেখ নেই। আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন করা খসড়ায় সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা জরিমানার কথা বলা হয়েছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের মুনাফা থেকে ৫ শতাংশ অর্থ যে সব মালিক দেবে না তাদের জন্য জেল বা কারাদণ্ডের বিধান রাখার কথা আইনের খসড়ায় প্রথমে ছিল। পরে দেখা গেল ‘সম্মানিত’ ব্যবসায়ীদের জেল দেওয়া ঠিক হবে না। এই খসড়াটি মন্ত্রী পরিষদ, সংসদ, বাছাই কমিটি ইত্যাদি ঘুরে চূড়ান্ত হয়ে শ্রম মন্ত্রণালয়ে যাবে। ৫ শতাংশ অর্থ মালিক শ্রমিক কল্যাণ ফাউণ্ডেশনে জমা না দিলে তার জন্য কারাদণ্ডের শাস্তির বিধান যুক্ত হবার সম্ভাবনা নেই। কারণ “সম্মানিত” ব্যবসায়ীদের সম্মানই তারা রক্ষা করবেন। তাতে শ্রমিক কল্যাণ নাই-বা হোক।
আর ১ লাখ টাকা জরিমানার বিধান করে আইন করা হলে তাতে কোনো মালিকই মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিকদের দেবে না। কারণ যদি প্রতি বছর একজন মালিক ১০ কোটি টাকা মুনাফা করে তার জন্য শ্রমিক কল্যাণ ফাউণ্ডেশনে তাকে দিতে হবে ৫০ লক্ষ টাকা। মালিকরা এ টাকা শ্রমিক কল্যাণ ফাউণ্ডেশনে না দিয়ে এক লক্ষ টাকা সরকারী তহবিলে জরিমানা হিসেবে দিলেও মালিকদের তেমন কোন ক্ষতি নেই।
তদুপরি বুর্জোয়া আইনে যত বাগাড়াম্বরই থাক না কেন তাতে শ্রমিকের স্বার্থ হাসিল হবে না। বুর্জোয়া আইনের বহু ফাঁকফোকর গলিয়ে মালিকরা পার পেয়ে যাচ্ছে। কারণ হলো এই রাষ্ট্র, তার সরকার, আইন, আদালত, পুলিশ, বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল এসবই মালিকদের; শ্রমিকের নয়, গরীব মানুষের নয়। আর এ কারণেই আগুনে পুড়িয়ে, গুলি করে শ্রমিক হত্যা, গণহত্যার পরও মালিকের কোনো শাস্তি হয় না। কিন্তু শাস্তি পাচ্ছেন, গ্রেফতার হচ্ছেন, জেলে যাচ্ছেন ন্যায্য মজুরীর দাবিতে আন্দোলন রত গার্মেন্টস শ্রমিকরা। তাই শ্রমিকদের রুখে দাঁড়াতে হবে বুর্জোয়া আইন, সরকার, পার্টি ও রাষ্ট্রেরই বিরুদ্ধে।

About andolonpotrika

আন্দোলন বুলেটিনটি হলো বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন ও বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের একটি অনিয়মিত মুখপত্র
This entry was posted in আন্দোলন ১৩. Bookmark the permalink.

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s