২০১০ সালের শেষ থেকে শুরু হয়ে ২০১১ সালব্যাপী ছিল দুনিয়া জোড়া শ্রমিক-কৃষক-নিপীড়িত জনগণের আন্দোলন-সংগ্রামে মুখর। এখনও তার ধারাবাহিকতা চলছে। আরব বসন্ত ছিল তারই অংশ। সারা দুনিয়া জুড়েই সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভাঙনের আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে লাখ লাখ জনগণ রাস্তায় নেমে আসছেন।
১৯ শতকে পুঁজিবাদের সংকট সমাধানে আবিষ্কার হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার তত্ত্ব ও সংগ্রাম। কিন্তু পুঁজিবাদ সংকট মোচনে রূপ পরিগ্রহ করে সাম্রাজ্যবাদে। অবশেষে মুক্তবাজার অর্থনীতি ও সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা ক’রেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। গত শতকের ৯০-এর দশকে করপোরেট পুঁজি ও মুক্তবাজার অর্থনীতি মুনাফার পাহাড় গড়লেও পুঁজিবাদের অর্থনীতি বর্তমানে আবারো সংকটে পতিত। একদিকে ব্যক্তি পুঁজির বিশাল উল্লম্ফন। দেশে দেশে বিশাল ধন ও বৈষম্যের সৃষ্টি। অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদের দেশে দেশে আগ্রাসন, যুদ্ধ- যার প্রকাশ হিসেবে দেখা দিচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা। ফলে ২১ শতকের দ্বিতীয় দশকে দেখা দিয়েছে চরম আর্থিক বিশৃংখলা এবং সামাজিক অস্থিতিশীলতা। তথাকথিত উন্নত ও উন্নয়নশীল সব দেশেই এই অস্থিরতা দেখা দেয়। যার প্রতিবাদে নিপীড়িত জনগণ রাজপথে নেমে আসেন।
গত এক দশকের “সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ” ও মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে আন্তর্জাতিক করপোরেট বাণিজ্যের সীমাহীন মুনাফার ধারায় পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনীতি চরম সংকটে নিপতিত। সাম্রাজ্যবাদের পালের গোদা খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এতটাই সংকটাপন্ন যে, সেখানকার শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্ত মানুষ ঘর-বাড়ি হারিয়ে পথে নেমেছেন। আমেরিকার শ্রমজীবী জনগণ কঠোর পরিশ্রম করেও ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অমানুষিক পরিশ্রম করেও প্রয়োজনীয় বিশ্রাম, কিছু ছুটি-ছাটা, অসুস্থ হয়ে পড়লে বাড়িতে থাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত। কাজ করছেন বেশি, মজুরি পাচ্ছেন কম। এই সব বৈষম্যের শিকার মানুষ ৯৯ শতাংশ, আর সুবিধাভোগিরা ১ শতাংশ। এই বঞ্চিত জনগণ আমেরিকার করপোরেট পুঁজির সদর দপ্তর ওয়াল ষ্ট্রিট বিরোধী আন্দোলনে হাজার হাজার জনতা সামিল হয়েছে। যাকে লক্ষ লক্ষ জনগণ সমর্থন করছেন। এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে লস এঞ্জেলস, শিকাগো, ওয়াশিংটন, ফ্লোরিডাসহ বড় বড় শহরে। এর ঢেউ এসে পড়েছে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে।
ইউরোপের দেশসমূহও মারাত্মক আর্থিক সংকটে পড়েছে। সরকারগুলো ঋণ ক’রে জনগণের কল্যাণের বদলে আন্তর্জাতিক করপোরেট ব্যবসায়ীদের ‘বেইল আউট’ নীতি নেয়ায় ইউরো জোন অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। যার বিরূপ প্রভাব বিশ্ব-অর্থনীতিতে পড়েছে। গ্রীস, আয়ারল্যাণ্ড, পর্তুগাল, স্পেন, ইতালী ও বৃটেনের অর্থনীতিতেও।
সাম্রাজ্যবাদী-আর্থিক মন্দা থেকে উদ্ভূত বুর্জোয়া শাসকদের গণবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্তরের জনগণ বিশেষত তরুণরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং বিদ্রোহ গড়ে তোলে। শ্রমজীবী তরুণ প্রজন্মের কলেজ ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার খরচ চালাতে গিয়ে ঋণের জালে আটকে যেতে হচ্ছে। কর্মজীবনের শুরুতেই হন্যে হয়ে ঘুরতে হচ্ছে একটি চাকুরির জন্য। হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষ এখন বেকার। স্পেনের বেকার সংখ্যা বর্তমানে ৫৩ লক্ষ। গ্রিসে মানুষ বাড়ি ভাড়া দিতে না পেরে গাড়িতে দিনপাত করছেন। খাবার জোগাড় করতে না পেরে মা-বাবারা বাচ্চাদের প্রতিপালনের জন্য কোনো সরকারি/বেসরকারি সংস্থায় হস্তান্তর করছেন।
এ বছর, ১২ মে, ২০১২ পুঁজিবাদী আর্থিক ব্যবস্থার প্রতি বিক্ষোভ-আন্দোলনের বর্ষপূর্তিতে স্পেনের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার লোক বিক্ষোভ করেছেন। এই ধরনের বিক্ষোভ যুক্তরাজ্য, পর্তুগাল ও জার্মানিতেও হয়েছে। গত বছর এই দিনে বিক্ষোভকারীরা সরকারের তথাকথিত ব্যয় সংকোচন নীতি ও ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের প্রতিবাদে বিশ্ববাসীকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল মাদ্রিদ থেকে। বেকারত্ব, ছাঁটাই, মজুরি হ্রাস, সেবা খাতে ব্যয় সংকোচনের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী দেশের জনগণকে। এই সংকট থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উদ্ভূত হয়েছে ওকুপাই আন্দোলন। এই আন্দোলন থেকে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে শ্লোগান উঠছে। এবং তাদের মধ্য থেকে আওয়াজ উঠছে পুঁজিবাদ নয়, সমাজতন্ত্রই মানব জাতির মুক্তির পথ।
গত শতাব্দীর ৬০-৭০ দশকে তরুণ প্রজন্মের বিপ্লবীরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদের তত্ত্বে সজ্জিত ও বলীয়ান হয়ে দেশে দেশে বিপ্লবী জাগরণ সৃষ্টি করেছিল। আজকে পুঁজিবাদের সংকটে সেটাই ঘটাতে হবে। সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের ধ্বংস এবং বিপ্লব অনিবার্য।