প্রসঙ্গ নেপাল পরিস্থিতি : প্রচন্ড-বাবুরামের ইউসিপিএন (এম) ভেঙে গেছে

দীর্ঘদিনের মতপার্থক্যের জেরে প্রচন্ড-বাবুরামের নেতৃত্বাধীন নেপালের পার্টি অবশেষে আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে গেছে। পার্টির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান কমরেড মোহন বৈদ্য ওরফে কিরনের নেতৃত্বাধীন বিভক্ত অংশ গত ১৬-১৮ জুন, ‘১২ এক জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠান করে। নতুন পার্টির নামকরণ করা হয় কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল-মাওবাদী (সিপিএন-এম)। পার্টির নতুন কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান হন কমরেড কিরন, জেনারেল সেক্রেটারী হন কমরেড রাম বাহাদুর থাপা ওরফে বাদল, সেক্রেটারী হন কমরেড চন্দ্র প্রকাশ গাজুরেল ওরফে গৌরব। সম্মেলন পরবর্তী ১৯ জুন,’১২ প্রকাশিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নেপাল হচ্ছে আধা সামন্তবাদী-আধা ঔপনিবেশিক-নয়া ঔপনিবেশিক দেশ। নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে এগিয়ে নেয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রধান দ্বন্দ্ব : দেশীয় পরিসরে বলা হয়েছে, মুৎসুদ্দি, আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া ও সামন্ত শ্রেণী এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ এক দিকে এবং অন্যদিকে ব্যাপক নেপালী জনগণের মধ্যকার দ্বন্দ্ব। আর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ ও নিপীড়িত জাতির মধ্যকার দ্বন্দ্ব।
দেশের বর্তমান বাস্তবতায় প্রধান রাজনৈতিক রণকৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে পিপল্স ফেডারেল রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষা করা।
সম্মেলন “প্রচন্ড পথ” ভুল বলে আখ্যায়িত করেছে। এবং প্রচন্ড-বাবুরামের লাইনকে গুরুতর দক্ষিণপন্থী সংশোধনবাদী বিচ্যুতি বলে মূল্যায়ন করেছে। তবে প্রাক্তন পার্টির (ইউসিপিএন-এর) মৌলিক লাইনগত ও নীতিগত বেশ কিছু নির্ধারক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কিরনপন্থীদের অবস্থান তথা সারসংকলন এখনও জানা যায়নি।
আগামী ২২-২৪ সেপ্টেম্বর,’১২ নতুন পার্টির ১ম জাতীয় সম্মেলন এবং আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি,’১৩ পার্টি জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

* এদিকে প্রচন্ড-বাবুরামের ইউসিপিএন (এম)-এর ৭ম প্লেনাম সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্লেনামে চেয়ারম্যান প্রচন্ড ৪০ পৃষ্ঠার রাজনৈতিক রিপোর্ট পেশ করে। গত ২০ জুলাই প্লেনাম শুরু হবার কিছু পরেই সভাস্থল রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। যতটা জানা যায়, ভোজপুর স্টেট কমিটির লিডার ভট্টরাই সমর্থক বলিদান শাহ যখন প্রচন্ড পেশকৃত রাজনৈতিক রিপোর্টের উপর বক্তব্য রাখছিল তখন প্রচন্ড সমর্থক জনৈক নেতা উচ্চ স্বরে চিৎকার ক’রে দাবি করতে থাকে যে, ভট্টরাই সমর্থকদের পূর্বে তাদের প্রতিনিধি অশোক জইসওয়ালকে বক্তব্য রাখার সুযোগ দিতে হবে। যুক্তি হিসেবে দাবি করে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ কেডারদের সমর্থন তাদের পক্ষে রয়েছে। তারা চিৎকার-চেঁচামেচি করতে থাকে। এমনি পরিস্থিতিতে ভট্টরাই সমর্থকরাও পালাটাপাল্টি একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে উভয় পক্ষের মাঝে মারামারি শুরু হয়ে যায়। পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে চেয়ার ছূঁড়ে মারে। এমনকি উপস্থিত প্রচন্ড ও ভট্টরাই উভয়েই প্রতিপক্ষের টার্গেটে পরিণত হয়। অল্পের জন্য প্রচন্ড নিক্ষিপ্ত চেয়ারের আঘাত এড়াতে সক্ষম হলেও নিক্ষেপকারীকে প্রচন্ডপন্থীরা মেরে আহত করে। পরে তাকে হাসপাতালে পাঠাতে হয়। প্রায় অর্ধঘণ্টাব্যাপী চলা মারামারির পরে পলিট ব্যুরোর জরুরী মিটিংয়ে আলোচনা-সমঝোতার ভিত্তিতে পুনরায় প্লেনাম শুরু হয়। এই ন্যাক্কারজনক পরিস্থিতি তাদের সংশোধনবাদে অধঃপতনের একটি প্রকাশ বৈকী।

* অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী বাবুরাম ভট্টরাই সংসদ ভেঙে দেবার পর ২২ নভেম্বর,’১২ সংসদ নির্বাচনের যে কথা রয়েছে তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে ব্যাপক সংশয়-সন্দেহ দেখা দিয়েছে। বহুল আলেচিত নতুন সংবিধান এখনও তৈরি না হওয়া ও বুর্জোয়া দলগুলোর জোড়াতালি মার্কা তথকথিত ঐকমত্যের সরকার গঠনের পথে অগ্রগতি না হওয়ায় এই পরিস্থিতি। প্লেনামেও সংসদ নির্বাচন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।
সুদীর্ঘ সময়কাল ধরেই প্রধানমন্ত্রী বাবুরাম ভট্টরাই অধিকতর ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী স্বার্থ ঘেষা হিসেবে নিজ পার্টি ও জনগণের মাঝে কানাঘুষা থেকে বর্তমানে ব্যাপকভাবে আলেচিত-সমালোচিত। বিশেষত গত বছর অক্টোবরে ভারতের সাথে বিআইপিপিএ (BIPPA-Bilateral Investment Projection and Promotion Agreement) চুক্তি করায় তাতে আরো বেশি মাত্রা যুক্ত করেছে। কিরনপন্থীরা পার্টির বিভক্তিপূর্বকালীন সময় থেকেই চুক্তির বিরোধিতা ক’রে আসছে। বর্তমানে ইউসিপিএন-এর শীর্ষস্থানীয় নেতা ও উপ-প্রধানমন্ত্রী নারায়ণ কাজী শ্রেষ্ঠা বলেছে, প্রধানমন্ত্রী বাবুরাম ভট্টরাই কর্তৃক ভারতের সাথে করা সকল চুক্তি, বিআইপিপিএ চুক্তিসহ, নেপালের জাতীয় সার্বভৌমত্বের জন্য ক্ষতিকর। এটা অবশ্যই সংশোধন করতে হবে। ৭ম প্লেনামে অধিকাংশ প্রতিনিধি ভট্টরাইকে উক্ত চুক্তি বন্ধ করতে জোর দাবি জানায় এবং সরকারকে অভিযুক্ত করে ত্রিভূবন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব ভারতীয় কোম্পানিকে দেয়ায় পরিকল্পনার জন্য। প্লেনামের রুদ্ধদ্বার অধিবেশনে সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা ও কেডারগণ প্রধানমন্ত্রী ভট্টরাই এবং তার কর্মপদ্ধতির কঠোরভাবে সমালোচনা করে। পক্ষান্তরে ভট্টরাই সমর্থক পলিটব্যুরো সদস্য দেবেন্দ্র পুডেল অভিযোগ করে যে, প্রচন্ড তার দলিলে পার্টির ভারতের প্রতি পলিসি বিষয়ে নীরব, অথচ তার সমর্থকরা ভট্টরাইকে সমলোচনা করে ভারতের প্রতি নমনীয় ও বিশ্বস্ত বলে।
উল্লেখ্য, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ সাম্পতিককালে নেপালে অনেক বেশি গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে নেপাল ও ভারত ব্যাটেলিয়ান পর্যায়ে যৌথ সামরিক মহড়া শুরু করার উদ্যোগ নিয়েছে। অতীতে যা কোম্পানী ও প্লাটুন পর্যায়ে হয়েছিল। গত বছর ৪৩ সদস্যের ভারতীয় কমান্ডো স্কোয়াড নেপালে এসেছিল “ভারত-নেপাল যৌথ গ্রুপ ট্রেনিং”য়ে অংশ নেয়ার জন্য। এদিকে ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত গুরুত্বের কারণে পুঁজিবাদী পরাশক্তি চীনও নেপালের প্রতি গভীরভাবে মনোযোগী আগ্রহী। সে কারণেও চীনের অন্তর্জাতিক বিভাগ সদ্য গঠিত কিরনপন্থী পার্টিকে চীন সফরের আমন্ত্রণ জানালে চেয়ারম্যান কিরণের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ইতিমধ্যেই চীন সফর ক’রে এসেছে।

About andolonpotrika

আন্দোলন বুলেটিনটি হলো বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন ও বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের একটি অনিয়মিত মুখপত্র
This entry was posted in আন্দোলন ১২. Bookmark the permalink.

Leave a comment