আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে শাসক শ্রেণীর দলগুলোর নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব যখন চরমে এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশের চাপে দেশের জনজীবন যখন বিপর্যস্ত তখন শোনা যাচ্ছে তৃতীয় শক্তির ডাক। এই তৃতীয় শক্তির ডাক দিলেন ‘নাগরিক ঐক্য’ কমিটি নামে নতুন এক সংগঠন। এই সংগঠনের প্রবক্তারা কেউই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বিরোধী নয়। সংগঠনের আহ্বায়ক, উপদেষ্টা, সদস্য এই দুই দল সমর্থিত। আবার কেউ কেউ এই দ্বি-দলের বাইরে থেকেও আছে। বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ একে সমর্থনও দিচ্ছে।
মহাজোট সরকার সাম্রাজ্যবাদের দালালী, ভারতের তাঁবেদারিতে ও নিজেদের লুটপাট এবং আগামী নির্বাচনে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে দেশে ফ্যাসিবাদী শাসন চালাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে গঠিত ‘নাগরিক ঐক্য’ কমিটি শাসক শ্রেণীর সরকার ও বিরোধী উভয় দলের সমালোচনা করেছে। সরকারী দলের পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতি, বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, দলীয়করণ, লুটপাট, দলীয় সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও আইন-শৃংখলা বাহিনীকে দলের লেজুড়ে পরিণত করা, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্ব গতি নিয়ে সমালোচনা করছে। সরকার ও বিরোধী উভয় দলের সমালোচনামুখর এই ‘নাগরিক ঐক্য’ কমিটির কথাবার্তায় মনে হচ্ছে এরা জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি। আসলে কি তাই? তাহলে তারা সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের বিরোধিতা করছে না কেন? তারা কেন শুধু এই দল দুটোকে, বা আরো ভালভাবে বললে শুধু তাদের কিছু নেতা-নেত্রীর কিছু কাজ বা দলের কিছু কর্মকান্ডকে বিরোধিতা করছে; সমগ্র শাসক শ্রেণীকে ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে বিরোধিতা করছে না। যারা সবাই মিলে বাংলাদেশকে লুটপাটের মৃগয়া ক্ষেত্রে পরিণত করেছে। তারা তা করতে পারে না, কারণ এরা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের দালাল শাসক শ্রেণীরই অংশ, অন্তত রাজনৈতিকভাবে তাদের শাসন বজায় রাখারই পক্ষে।
তাহলে এই ‘নাগরিক ঐক্য’ কমিটি কি চায়? আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র নেতৃত্বে শাসক শ্রেণীর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব যখন তীব্র হয়ে খুনাখুনির পর্যায়ে পৌঁছে, পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। যা সাম্রাজ্যবাদ-শাসক শ্রেণীর জন্যই সমস্যা সৃষ্টি করে। সমাধান হিসেবে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল যা জনগণ চায় না। শাসক শ্রেণীর জন্যও অসুবিধাজনক। এমন পরিস্থিতিতে বুর্জোয়া সুশীলরা চায় দেশে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ থাকুক। তারা আসলে একে কিছু সহনীয় ও মার্জিত করতে চায় মাত্র। তারা চায় সংসদীয় বুর্জোয়া ‘গণতন্ত্র’ চর্চা হোক। বিদেশী লুটেরা বিনিয়োগকারীরা যাতে সুষ্ঠুুভাবে বিনিয়োগ করতে পারে সেই পরিবেশ বজায় থাকুক। তাই শাসক শ্রেণীর সুশীলরা এই প্রধান দুই ধারাকে চাপ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনে তৃতীয় শক্তি হিসেবে জনগণকে বিভ্রান্ত ক’রে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ প্রশস্ত করার প্রচেষ্টা হিসেবেই এই নাগরিক কমিটির জন্ম দিয়েছে।
তারা বলছে- সততা, দক্ষতা ও মেধাবী রাজনৈতিক নেতৃত্ব, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করলে, স্থানীয় সরকার কাঠামো শক্তিশালী করা হলে জনকল্যাণকর রাষ্ট্র কায়েমে সক্ষম হবে। শ্রেণী-শোষণ ভিত্তিক সমাজে রাষ্ট্র কিভাবে জনকল্যাণকর হবে? যেখানে শ্রমিক, কৃষক ও মধ্যবিত্ত জনগণকে শোষণের উপর শাসক শ্রেণী ও রাষ্ট্র টিকে থাকে। তারা দাবি করে সমাজের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, নারীর প্রতি অসম্মান, সকল প্রকার অবৈধ কার্যক্রমে ‘নাগরিক ঐক্যে’র ব্যানারে জনগণকে সাথে নিয়ে সোচ্চার থাকবে। এ ধরনের কর্মসূচি সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা চালিত এনজিও সংস্থাগুলো ক’রে থাকে। এ সবগুলোই হচ্ছে নাগরিক সমাজকে বিভ্রান্ত করে কাছে টেনে জনগণের প্রকৃত মুক্তির পথকে আড়াল করা। যা শোষক শ্রেণী ও সাম্রাজ্যবাদী পলিসির অন্তর্ভুক্ত।
শোষক শ্রেণীর সংসদীয় গণতন্ত্র যখন ফ্যাসিবাদে রূপ নেয় তখন জনগণের আন্দোলনকে নিজেদের হাতে রাখার জন্যই সাম্রাজ্যবাদ, শাসক শ্রেণী এই কৌশল অবলম্বন করে। তৃতীয় শক্তির উত্থানের কথা যারা বলছে তাদের শ্রেণীগত অবস্থ্ান সম্পর্কে জনগণের ধারণা রয়েছে। এই বুর্জোয়া সংসদ, এই রাষ্ট্রীয় কাঠামো, এই নির্বাচনী ভোটের গণতন্ত্রই তাদের মূল মন্ত্র।
আজ জনগণের যে পাহাড়সম সমস্যা ও অধিকারহীনতা তাকে দেখতে হবে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী এই লুটেরা অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে। ধনীক শ্রেণীর রাজনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাই এর রক্ষক। সুতরাং জনগণের প্রকৃত মুক্তির জন্য এই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার উচ্ছেদ প্রয়োজন। শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক ঐক্যের ভিত্তিতে সমাজতন্ত্রমুখীন নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব গড়ে তুলতে হবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে।
তাই সকল গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল লেখক-সাংবাদিক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী-ছাত্র-শিক্ষক ও নাগরিক সমাজের প্রতি আহ্বান- ‘নাগরিক ঐক্য’ কমিটির আহ্বানে বিভ্রান্ত না হয়ে জনগণের প্রকৃত মুক্তির লক্ষ্যে কাজ করুন। ‘নাগরিক ঐক্য’ কমিটির মুখোশ জনগণের সম্মুখে উন্মোচন করুন।