’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ/৩ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শাসক বুর্জোয়া শ্রেণী ও রাষ্ট্রের মিথ্যাচার, ইতিহাসবিকৃতি ও প্রতারণার কিছু উদ্ঘাটন

আগের পর্বগুলোতেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ’৭১-সালে আওয়ামী লীগের বুর্জোয়া, উঠতি বুর্জোয়া নেতৃত্ব জনগণের প্রকৃত মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে বহু বানানো ও মিথ্যাচার শুরু থেকেই করে চলেছে। বাংলাদেশের বিগত ৪০ বছরের আমলে গোটা শাসকশ্রেণী ও তাদের রাষ্ট্র বিপুল মাত্রায় এই মিথ্যাকে বিকশিত করেছে। এটা তারা করেছে মুক্তিযুদ্ধকালে তাদের নির্লজ্জ আপোষবাদীতা, সুবিধাবাদ ও আত্মসমর্পণবাদকে আড়াল করার জন্য, নিজেদের ব্যর্থতা ও বিশ্বাসঘাতকতাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য। বহু অসংখ্য বিষয়ে ও খুঁটিনাটি প্রশ্নে তাদের এ মিথ্যা বিস্তৃত। তবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কিছু প্রধানতম বিষয়ের মিথ্যাচারগুলো ইতিহাসের জঘন্যতম বিকৃতি ঘটিয়ে চলেছে, যার কিছু উদ্ঘাটন আমরা নিচে করবো।

১। স্বাধীনতার ঘোষণাঃ
স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছিল, কখন দিয়েছিল, অথবা সেরকম কোন ঘোষণা আদৌ ছিল কিনা তা নিয়ে শাসকশ্রেণী অবিরাম মিথ্যাচার করে চলেছে।
আওয়ামী পন্থীরা দেখাতে চায় যে, পাক বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের আগে শেখ মুজিব ২৫ মার্চ রাতে একটি ঘোষণা তদানীন্তন ইপিআর-এর বেতার মারফত নাকি দিয়ে গেছেন। এ দাবি যে এক নির্লজ্জ মিথ্যা তা প্রমাণ করার জন্য একটি প্রশ্ন করাই যথেষ্ট যে, কোন জাতীয় নেতা জাতির স্বাধীনতা ঘোষণা দেবার পর পরই স্বেচ্ছায় শত্রু’র হাতে ধরা দিতে পারে কি?
নির্মল সেন বা আরো কেউ কেউ তাদের মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিচারণে সে সময়ে বেতারে ক্ষীণকন্ঠে এমন ঘোষণা নিজেরা শোনার কথা বলে থাকেন। কিন্তু এই স্মৃতিকে রাজনৈতিক বিশ্বাসজনিত মানসিক বিভ্রম যদি না-ও ধরা হয়, তাহলেও এটা যে শেখ মুজিবই দিয়েছিল তার কোন অকাট্য প্রমাণ কেউ দিতে পারে না। খুব কম লোকই এটা শোনার দাবী করে থাকে। এমন একটি ঘোষণা, অথচ দু’একজন ছাড়া কেউ এটা শুনলো না! বিশেষত এই কারণে এটা অন্য কেউ শেখ মুজিবের নামে দিতে পারে যে, তখন শুধু শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের কিছু নেতা বাদে বাকি অনেকেই এমন একটি ঘোষণার প্রয়োজন উপলব্ধি করছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিব বা আওয়ামী দপ্তর থেকে কোন দিকনির্দেশনা ছিল না। এ অবস্থায় স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহীরা স্বউদ্যোগে বিবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করেছিলেন। সবাই জানে যে, মাত্র একদিনের মাথায় চিটাগাং থেকে সংগ্রামী কর্মীদের উদ্যোগে জিয়াউর রহমান এক ঘোষণায় প্রথমে নিজেকে প্রেসিডেন্ট দাবী করেন ও পরে ‘শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে’স্বাধীনতার একটি ঘোষণা দেন। নওগাঁ (দেখুন ওহিদুর রহমানের পুস্তক) বা দেশের আরো কোথাও কোথাও-ও এমনটা ঘটেছিল। স্পষ্টতই এসব ঘোষণায় মুজিবের নাম যুক্ত হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে; কোন তথ্যগত সত্যতার ভিত্তিতে নয়। অনেকেই তখন বিশ্বাস করছিলেন এবং প্রচারও করছিলেন যে, মুজিব গোপনে চলে গেছেন এবং গোপনে থেকে তিনি মুক্তিযুদ্ধকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু তা পরে মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
বলা হয়ে থাকে যে, চিটাগাং-এ আওয়ামী নেতার কাছে নাকি এমন একটি ঘোষণা ইপিআর-এর তারবার্তায় পৌছেছিল। চিটাগাং আওয়ামী লীগের কেউ কেউ এমন একটি ঘোষণা সেসময়ে সাইক্লোস্টাইলে ছেপে প্রচারও করেছিল। কিন্তু প্রশ্নটা স্বাভাবিক যে, শেখ মুজিব আর কোন লোক কি পেলেন না এমন একটি সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা পাঠাবার জন্য। যখন কিনা পাকবাহিনীর ক্র্যাকডাউনের মাত্র ঘন্টা খানেক আগেও তাজুদ্দিনসহ অনেক শীর্ষ নেতাই মুজিবের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন। এমনকি তাজুদ্দিন নিজে একটি ঘোষণা দেয়া বা তা রেকর্ড করার জন্য শেখ মুজিবকে পিড়াপিড়ি পর্যন্ত করেছেন, কিন্তু মুজিব তাতে রাজী হননি এই যু্ক্তিতে যে তাহলে পাক সরকার তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় সহজেই জড়াতে পারবে (দেখুন ‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর’ ও আরো অন্যান্য বই)।
ঠিক এ জায়গাগুলোতে আটকে গিয়ে বহু আওয়ামী নেতা এমনও বলে থাকেন যে, ৭ মার্চের ভাষণই নাকি স্বাধীনতার ঘোষণা। এমনকি সাম্প্রতিককালে খোদ সংসদে আওয়ামী স্পিকার নিজে এটা বলেছেন। তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে আরেকটি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবার প্রয়োজনটা কি ছিল? আর ৭ মার্চের ভাষণটি যে তা ছিলনা সেটা আমরা এই সিরিজের ২য় পর্বেও ব্যাখ্যা করেছি। সবাই জানেন যে, ঐ দ্বিমুখী ভাষণটির পর দীর্ঘ প্রায় ১৮ দিন শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ পাক সরকারের সাথে আলোচনা করে গেছেন কোন স্বাধীনতার প্রশ্নে নয়, বরং পাকিস্তান কাঠামোর মধ্যে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের বিষয় নিয়ে। স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে কেউ এটা করতে পারে না।
অন্যদিকে জিয়াউর রহমানকে যে শাসকশ্রেণীর আওয়ামী বিরোধী অংশ স্বাধীনতার ঘোষক বলে থাকে তার কিছুটা সত্যতা থাকলেও একটি স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনাকারী ঘোষণা বলতে যা বোঝায় সেটা তেমনটা ছিল না। কারণ, বাস্তবে সেই ঘোষণার অনেক আগেই সমগ্র জাতি স্বাধীনতা যুদ্ধে নেমে পড়েছিলেন কারও কোন ঘোষণা ছাড়াই, পাকবাহিনীর সর্বাত্মক গণহত্যার মুখে নিজ অস্তিত্বের স্বার্থেই। খোদ চিটাগাং-এ জিয়াউর রহমানের বিদ্রোহের আগেই যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। ঢাকার পিলখানায় হয়েছিল। তার আগে ১৯ মার্চ ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরে হয়েছিল। তারও আগে ১ মার্চে গণঅভ্যূত্থানের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতার ঘোষণা জনতা দিয়ে ফেলেছিলেন। সর্বাত্মক যুদ্ধে একটি অনুপ্রেরণা হিসেবে জিয়ার ঘোষণার একটি গুরুত্ব সেসময়ে ছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু এসবের বহু আগে বিশেষত বিভিন্ন মাওপন্থী গ্রুপ স্বাধীন পূর্ব বাংলার কর্মসূচি দিয়েছিল। (মার্চের পূর্বে সেটা সঠিক ছিল কিনা তা পৃথক বিতর্কের বিষয়)। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়েছিল। এবং ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে সংগ্রামী ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়েছিল। বাস্তবে বামপন্থী, জনগণ ও ছাত্রসমাজের এসমস্ত উদ্যোগেরই একেবারে পিছনে পড়ে ছিল আওয়ামী নেতৃত্ব এবং শেখ মুজিব। তারা কখনই স্বাধীনতা যুদ্ধ করতে চায়নি, তাই, তার কোন প্রস্তুতিও তারা নেয়নি এবং কোন ঘোষণাও তারা দেয়নিÑ এটাই হলো প্রকৃত সত্য। এসবকে ঢেকে রাখার জন্যই তারা আজ নিত্যনতুন ব্যাখ্যা ও বয়ান দিচ্ছে ভন্ড ইতিহাস তৈরীর জন্য।

২। মুজিবনগর সরকারঃ
মুক্তিযুদ্ধের সূচনাতেই শেখ মুজিব স্বইচ্ছায় পাকবাহিনীর কাছে ধরা দেন এবং অন্যান্য আওয়ামী নেতৃত্ব জনগণকে পাকবাহিনীর গোলার মুখে ফেলে রেখে ভারতে পলায়ন করেন। সেখানে তারা ভারতীয় সরকারের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের কাছে নিজেদেরকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করেন।
১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার (বর্তমানের মেহেরপুর) সীমান্তবর্তী একজায়গায় আওয়ামী লীগের একটি “স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার”-এর শপথ অনুষ্ঠান হয়। এর দ্বারা দেশের জনগণকে ও বিশ্বকে দেখানোর চেষ্টা চলে যে, আওয়ামী লীগ দেশের মধ্যে থেকেই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছে। কিন্তু এটা ছিল এক ডাহা মিথ্যা কাহিনী ও জনগণের সাথে এক জঘন্য প্রতারণা। কারণ, এই সরকারের গঠন, কার্যপরিচালনা এবং যুদ্ধ পরিচালনা কোনটাই দেশের মধ্যে থেকে করা হয়নি। ১০ এপ্রিল ভারতের মাটিতে ভারতের পরামর্শে ও উদ্যোগে এই প্রবাসী সরকারটি গঠিত হয় আওয়ামী লীগের নেতাদের দ্বারা। তারা কলকাতাতেই তাদের হেড অফিস স্থাপন করে। গোটা মুক্তিযুদ্ধকালে এই সরকার কখনো বাংলাদেশে আসেনি বা থাকেনি। শুধুমাত্র ১৭ এপ্রিল এই শপথ অনুষ্ঠানটি তারা করেছিল দেশের মধ্যে, তবে সীমান্তের একেবারে কাছের একটি এলাকায়। সরকারটি এসেছিল ভারত থেকে, এসে শপথের অনুষ্ঠানটি শেষ করেই তারা পুনরায় দ্রুত ভারতে ফিরে যায়। বিদেশী সাংবাদিকদেরও ভারত থেকেই আনা হয়েছিল এবং দ্রুত ভারতে ফেরত নেয়া হয়েছিল।
‘৭১-সালে যখন কিনা রাস্তাঘাট এতোটা ছিল না, বাংলাদেশের বহু জায়গাই ছিল দুর্গম, মোবাইল ফোন ছিল না, ইন্টারনেট ছিল না, ফোনও ছিল খুবই দুর্লভ, গুটিকয় দালাল বাদে সমস্ত জনগণ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, পাকবাহিনী তখনো গুছিয়ে ওঠেনি এবং ২৫ মার্চের পর প্রায় একমাস ধরে দেশের বহু জেলাশহর পর্যন্ত ছিল মুক্ত, তখন আওয়ামী নেতৃত্ব দেশে থেকে সরকার গঠন করতে, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে সাহস করেনি। কতটা সুবিধাবাদী, ভীতু ও ব্যর্থ ছিল তারা। কুষ্টিয়ার শপথ অনুষ্ঠানের জায়গাটিকে পরে তারা মুজিবনগর বলে আখ্যায়িত করেছে। কিন্তু ’৭১-সাল জুড়ে মুজিবনগরে কোন সরকার ছিল না। যে সরকারটিকে মুজিবনগর সরকার বা স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার বলা হতো সেটা ছিল কলকাতায়। এটা যে ভারতের নির্মিত একটি অধীনস্ত সরকার ছিল সেটা বলাই বাহুল্য। এই সত্যকে গোপন করার জন্যই তারা ‘মুজিবনগর সরকার’-এর মিথ্যাটি বাজারে ছেড়েছিল।
* প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী এমসিএ-দের (সংবিধান সভার সদস্য) নিয়ে এভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের কোন রাজনৈতিক, আইনগত ও নৈতিক বৈধতা ছিল না। আওয়ামী লীগের এই নেতারা পাকিস্তানের একটি নতুন সংবিধান রচনার জন্য গঠিত একটি সংবিধান সভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল। ’৬৯-এর গণঅভ্যূত্থানকে বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করার জন্য পাক-সরকার ’৭০-এর নির্বাচনের একটি টোপ হাজির করে। এভাবে পাকিস্তানী সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের ষড়যন্ত্রে গণঅভ্যূত্থান সাময়িকভাবে স্তিমিত হয়। তথাপি পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত বিস্ফোরণোন্মুখ। এ অবস্থায় পূর্ব বাংলার তৎকালীন অপর বৃহৎ রাজনৈতিক পার্টি ভাসানী ন্যাপ নির্বাচন বয়কট করে। ভাসানী ন্যাপের এই বয়কটের পিছনে সে সময়কার সকল মাওপন্থী পার্টি ও সংগঠনের মদদ ও সমর্থন ছিল। তারা স্বতন্ত্রভাবে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা ব্যতীত অন্য যেকোন সমাধানকে প্রত্যাখ্যান করার আহ্বান জানিয়েছিল। ফলে ’৭০-এর নির্বাচনটি হয়েছিল মার্কিনী পরিকল্পনায় তাদের দুই আস্থাভাজন পক্ষ পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকশ্রেণী ও আওয়ামী লীগের বাঙালি বুর্জোয়া নেতৃত্বের মধ্যকার ক্ষমতা ভাগাভাগির নির্বাচন। আওয়ামী লীগ ব্যতীত অন্য সকল স্বাধীনতাকামী পার্টি ও সংগঠন, বিশেষত ভাসানী ন্যাপের নির্বাচন বর্জনের ফলে যে খোলা মাঠ সৃষ্টি হয়েছিল তাতে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় ১৬২টির মধ্যে ১৬০টি আসনে বিজয়ী হয়। সমগ্র পাকিস্তানে আসন সংখ্যা ছিল ৩০০।
সুতরাং এমন একটি পাকিস্তানপন্থী নির্বাচনে নির্বাচিত সদস্যদের কোন অধিকারই ছিল না স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠন করার। ১ মার্চের পর সমগ্র জাতি যখন স্বাধীনতা সংগ্রামে নেমে পড়ে, বিশেষত ২৫ মার্চের পর যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তখন উপরে উল্লেখিত সকল স্বাধীনতাকামী পার্টি ও দল এ যুদ্ধে ও সংগ্রামে অগ্রগামী ভূমিকা গ্রহণ করে। শুধু তাই নয়, পার্টি-বহির্ভূত ব্যাপক জনগণ তাতে অংশ নেন, তাতে সামিল হন বিভিন্ন উপায়ে। তাই, এ অবস্থাটা ছিল পরিপূর্ণভাবেই ভিন্ন ’৭০-সালের নির্বাচনের সময় থেকে। এ অবস্থায় শুধুমাত্র সকল স্বাধীনতাকামীদের প্রতিনিধি নিয়ে একটি অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠনই মুক্তিযুদ্ধে সমগ্র জাতির প্রতিনিধিত্ব করতে পারতো। কিন্তু সে উদ্যোগ না নিয়ে ভারতে গিয়ে ভারতের পরামর্শে ও সিদ্ধান্তে এককভাবে তড়িঘড়ি করে আওয়ামী এমসিএ-দের নিয়ে তথকথিত স্বাধীন সরকার গঠন ছিল একদিকে আওয়ামী লীগের একদলীয় স্বৈরাচারী বুর্জোয়া নীতির প্রকাশ, যা বাংলাদেশ হবার পর পদে পদে প্রমাণিত হয়েছে; আর অন্যদিকে এটা ছিল এই নতমুখী সুবিধাবাদী বুর্জোয়া নেতৃত্বদের দিয়ে জনগণের মুক্তিসংগ্রামকে হাইজ্যাক করার এক গভীর ভারতীয় ষড়যন্ত্রের ফল।
এ কারণেই আমরা দেখবো যে, ঐ সময়ে খোদ ভাসানীকে ভারতে গৃহবন্দী করে রাখতে। ভারতে বামপন্থী, বিশেষত মাওপন্থী মাত্র স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরকে গ্রেফতার বা হত্যার ষড়যন্ত্র করতে। অথবা দেশের ভেতরে আওয়ামী তথাকথিত মুক্তিবাহিনীর দ্বারা, বিশেষত মুজিব বাহিনী দ্বারা মাওপন্থীদের হত্যা ও নির্মূলের ষড়যন্ত্র পরিচালনা করতে।

৩। ৩০ লক্ষ শহীদঃ
মুক্তিযুদ্ধকালে ৩০লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছেন একথাটিকে একেবারে স্বতসিদ্ধ আকারে তোতাপাখির মত সর্বত্র বলে বলে একে কোরানের আয়াতের মত ধ্রুব সত্য বানিয়ে ফেলা হয়েছে।
‘৭১-সালে পাকবাহিনী ইতিহাসের এক জঘন্য গণহত্যা করেছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। তারা শুধু অগণিত মানুষকে হত্যা করেছিল তাই নয়, তারা বর্বর অত্যাচার করেছিল সংগ্রামী মানুষের উপর, বন্দী মুক্তিযোদ্ধাদের উপর। নারীদের উপর তারা মধ্যযুগীয় অত্যাচার করেছিল। তারা বহু গ্রাম-গঞ্জ পুড়িয়ে দিয়েছিল। ৭০ লক্ষের মত মানুষ দেশছাড়া হয়েছিল। তাই এই বর্বরতার বিরুদ্ধে জাতি ও জনগণকে সোচ্চার থাকতে হবে সুদীর্ঘকাল।
কিন্তু অত্যাচার আর প্রতিরোধ সবকিছুরই বাস্তবভিত্তিক সত্য ইতিহাস থাকতে হবে। সঠিক তথ্যভিত্তিক ইতিহাস রচনায় অত্যাচারিত ও সংগ্রামী মানুষ ও প্রগতিশীল আদর্শের কোন ভয় থাকতে পারে না। কারণ, সেটা তাকে সত্যের পথ দেখায় এবং বাস্তবকে বুঝতে সহায়তা করে। মিথ্যা ইতিহাস সৃষ্টি করে তারা, যারা সত্য ইতিহাসে ভয় পায়, তাতে যাদের স্বার্থহানী হয়।‘
‘৭১ সালে কত মানুষ শহীদ হয়েছিলেন? শাসকশ্রেণী ও রাষ্ট্র বলে ৩০ লক্ষ। এই তথ্য কীভাবে জানা গেল? কোন অনুসন্ধঅনের ভিত্তিতে? ৩০ লক্ষ মানুষ হত্যার তথ্যটি সঠিক যে হতে পারে না সেটা বিভিন্ন প্রাপ্ত তথ্যাদির হিসেবেই বেরিয়ে আসে। এটা হলে গড়ে প্রতিটি গ্রামে ৫০ জনের মত করে শহীদ হবার কথা। এটি যে একটি অসম্ভব তথ্য তা তৎকালে যারা প্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারবেন। এখনো ৫৫/৬০ বছরের উর্ধ যেকোন মানুষই সেটা বলতে সক্ষম। এমন মানুষ এখনো প্রতিটি গ্রামে কয়েকজন করে জীবিত রয়েছেন।
সেসময়ে সবচেয়ে বড় হত্যার ঘটনা ঘটেছিল খোদ ঢাকা শহরে ২৫ থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত সময়ে। তৎকালীন বিবিসি সাংবাদিক সাইমন ডিং সেদিনও বলেছেন যে, সেসময়ে ঢাকায় ৭ হাজার লোক নিহত হতে পারে। নিঃসন্দেহে আধুনিক বিশ্বে এ এক ভয়ংকর ব্যাপার। এরপর আর যদি একটি হত্যাও না হতো তা হলেও পাকিস্তানী শাসক ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে এজন্য বর্বর ও যুদ্ধাপরাধী আখ্যায়িত করাটা সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত হতো। পাকবাহিনী যদি ৩০ লক্ষ লোক হত্যা না করে থাকে, যদি তারা ১ বা ২ লক্ষ মানুষ হত্যা করে থাকে, তাহলেও যেমন তাদের বর্বরতাকে কমিয়ে দেখার সুযোগ নেই, তেমনি মুক্তিযুদ্ধে জনগণের ত্যাগ ও সংগ্রামকেও ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। তাহলে কেন একটি অপ্রমাণিত তথ্যকে ইতিহাসের অংশ করা হচ্ছে? জ্ঞানী আহমদ শরীফ স্পষ্টভাবেই বলতেন ২ লক্ষের বেশী শহীদ তখন হয়নি। প্রয়াত আওয়ামী নেতা মোনায়েম সরকার তার পুস্তকে বলেছেন হত্যার সংখ্যাটি ৮০ হাজারের মত হবে।
তার চেয়েও বড় বিষয় হলো, ১ লক্ষ বা ৩০ লক্ষ যা-ই হোক না কেন, একটি জাতিগত মুক্তিসংগ্রামের ‘বিজয়’-এর পর শাসকশ্রেণী ৪০ বছরেও তার শহীদদের তালিকা তৈরীর নগণ্য, কিন্তু অসীম গুরুত্বপূর্ণ কাজটি কেন করলো না? এটা কি অসম্ভব কোন কাজ ছিল? এমনকি এখনো কি তা করা সম্ভব নয়? যেখানে মাত্র ৬ মাস সময়ে ৮ কোটি ভোটারের ছবিসহ পরিচয়পত্র করা যায়, সেখানে কথিত ৩০ লক্ষ শহীদের নামের তালিকা, তাদের ঠিকানা, নিহত হবার ঘটনা, তারিখ, এমনকি তাতে স্থানীয় পাকপন্থী সন্ত্রাসীদের নাম ও ভূমিকা লিপিবদ্ধ করা আজকের ‘ডিজিটাল’ যুগে কোন সমস্যাই হতে পারে না। কেন শাসকশ্রেণীর কোন পক্ষ বা রাষ্ট্রযন্ত্র কখনো এর উদ্যোগ নেয়নি? কারণটা হলো তারা জানে যে, তারা যে দায়দায়িত্বহীনভাবে তাদের পল্টনি ভাষণের স্বভাবে ৩০ লক্ষ শহীদের কথা বলে থাকে, তার মিথ্যা তাহলে প্রকাশ হয়ে যাবে।
এর মধ্য দিয়ে একদিকে শহীদদের প্রতি তারা যে আসলে আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধাশীল নয় তার প্রকাশ ঘটে, অন্যদিকে এ সময়ে আরো বহু অন্যায় হত্যাকান্ড যা আওয়ামী তথাকথিত মুক্তিবাহিনীর মাধ্যমে ঘটেছে তাকে চাপা দেয়ার অসৎ উদ্দেশ্যও বোঝা যায়। আমরা আগেই বলেছি সে সময়ে আওয়ামী মুক্তিবাহিনী ও ভারত সরকার কীভাবে মাওপন্থী স্বাধীনতা যোদ্ধাদেরকে হত্যা করেছে বা তার ষড়যন্ত্র করেছে। এছাড়াও বিহারী নামে পরিচিত উর্দুভাষী জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যার দায়ে আওয়ামী মুক্তিবাহিনীও দায়ী ছিল। যা সৈয়দপুর, রাজবাড়ী, ময়মনসিংহসহ বহু জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের সূচনাতেই ঘটেছিল।
এ রকম আরো মিথ্যা ইতিহাস দিয়ে পুস্তক, টিভি, নাটক, সিনেমা, এবং শিশুদের পাঠ্যপুস্তক ভরে রাখা হয়েছে। শেখ মুজিবকে দাবী করা হয় মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক। বলা হয়ে থাকে ১৬ ডিসেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় হয়েছে। বলা হয়, মাওপন্থীরা মুক্তিযুদ্ধকে বিরোধিতা করেছে। বলা হয় ভারত মুক্তিযুদ্ধের মহান বন্ধু। এসবই তথ্যগতভাবে ভুল। এবং ইতিহাসবিকৃতি। সেগুলোকেও অবশ্যই সত্য ইতিহাসের স্বার্থে তুলে ধরতে হবে।

৩১ মার্চ, ২০১২

About andolonpotrika

আন্দোলন বুলেটিনটি হলো বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন ও বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের একটি অনিয়মিত মুখপত্র
This entry was posted in আন্দোলন ১১. Bookmark the permalink.

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s