ফিলিপাইনের বিকাশমান গণযুদ্ধের কারিগর মাওবাদী নেতা কমরেড কা রজার যুগ যুগ বেঁচে থাকুন!

ফিলিপাইনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিপি)’র কেন্দ্রীয় মুখপাত্র কমরেড গ্রেগরিও রজাল যিনি “কা রজার” নামে ব্যাপকভাবে সুপরিচিত, গত ২২জুন, ২০১১ হার্ট এ্যাটাকে লুজোনের গেরিলা ফ্রন্টে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর।
কমরেড কা রজার ১৯৭৩ সালে ছাত্রজীবন ত্যাগ করে ফিলিপাইন কমিউনিস্ট পার্টির পেশাদার গোপন বিপ্লবী জীবন বেছে নেন। এর পূর্বে ৭০ দশকে তিনি ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক হিসেবেও সক্রিয় দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ফিলিপাইনে বিভিন্ন গেরিলা জোন গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ৭০-৮০’র দশকে তিনি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পার্টি-শাখা দক্ষিণ তাগালগ অঞ্চল এবং পর্বতময় কুইজোন-বাইকোল জোনে বিপ্লবী ভিত্তি গড়ে তোলা, সুসংহত ও প্রসারিত করার ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় অবদান রাখেন। এর পূর্বে বাতাঙ্গাস, লাগুনা এবং মিন্দোরো গেরিলা জোন প্রতিষ্ঠার অত্যন্ত দুরূহ প্রচেষ্টার প্রথম উদ্যোগেরও অংশ ছিলেন তিনি। এবং ৭০ দশকের শেষদিকে কুইজোন-বাইকোল জোনের অধীনস্থ ক্যামারিনস নরটি গেরিলা জোন গড়ায় তিনি নির্ধারক ভূমিকা পালন করেন। ’৮৩-তে গেরিলা জোনের বিস্তৃতি প্রসারিত করার নেটওয়ার্ক হিসেবে পূর্ব-বাতাঙ্গাস থেকে মধ্য-কুইজোন পর্যন্ত তিনটি গেরিলা জোনঃ লুজোন, ভিসায়্যাস ও মিন্দানাও প্রতিষ্ঠা করার প্রধান দায়িত্ব অর্পিত হয় তাঁর ওপর। ১৯৮২ সালে স্বৈরাচারী একনায়ক প্রেসিডেন্ট মার্কোস “পেপল”পরিদর্শনে গেলে সিপিপি কমরেড কা রজারকে এর বিরুদ্ধে ব্যাপক গণসমাবেশিতকরণের জন্য কেন্দ্রীয় কমান্ডের প্রধান দায়িত্ব প্রদান করে। কমরেড কা রজার সফলভাবে এ দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮৫ সালে তিনি দক্ষিণ তাগালগ পার্টি-কমিটির সম্মেলনে কার্যকরী কমিটিতে নির্বাচিত হন। ১৯৮৬-তে “এডসা বিপ্লবে”র পর তিনি দক্ষিণ তাগালগ আঞ্চলিক পার্টি-কমিটির সম্পাদকের দপ্তরে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯০ সালে তাগালগে পার্টি পরিচালিত রেডিও ষ্টেশন রেডিও পাকিকিবাকা স্থাপনে কমরেড কা রজার প্রধান পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। এটা ছিল দক্ষিণ তাগালগে প্রথম গেরিলা সম্প্রচার কেন্দ্র। গোপনে থেকে দমনরত সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা-নজরদারি কৌশলে এড়িয়ে বিপ্লবের কণ্ঠস্বর রেডিও পাকিকিবাকা-কে টিকিয়ে রেখে পার্টি-প্রচারক হিসেবে তিনি আরও বেশি শাণিত হন। ফলে শীঘ্রই পাকিকিবাকা রাজধানী ম্যানিলাসহ তাগালগ অঞ্চলের গ্রাম ও শহরের বিপ্লবী জনগণের নিকট প্রিয় হয়ে ওঠে। সেনাবাহিনীর তীব্র দমনের পরিস্থিতিতে গেরিলা রেডিও সচল রাখতে গিয়ে, চলমানতা বজায় রাখতে গিয়ে দিন-রাত অক্লান্তভাবে কাজ করেছেন তিনি।
১৯৯৪ সালে তিনি ফিলিপাইন কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র হন। এক দশকেরও বেশি সময় এই দায়িত্ব পালন করেন তিনি। মুখপাত্রের দায়িত্বে থেকে পার্টিকে প্রতিষ্ঠা ও বিপ্লবকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে উপযুক্ত সময়ে নিরাপত্তা-গোপনীয়তা বজায় রেখে ভারী বৃষ্টি ও প্রচণ্ড রৌদ্রতাপকে উপেক্ষা ক’রে মিডিয়ায় সাক্ষাতকার দিয়েছেন।
১৯৯৭ সালে তিনি প্রথম হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পরে সুস্থ হয়ে তাঁর বিপ্লবী দায়িত্বে ফিরে আসেন। ২০০০ সালে দ্বিতীয় স্ট্রোকের পর কয়েকমাসের জন্য ছুটিতে থেকে প্রথমবারের মতোই বিপ্লবী দায়িত্বে ফিরে এসেছিলেন। ২০০৬ সালে তৃতীয়বার স্ট্রোকে তাঁর বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ায় তিনি আর দায়িত্বে ফিরে আসতে পারেননি। এমনি পরিস্থিতিতে ২০০৬ থেকে আমৃত্যু পার্টি তাঁর তত্ত্বাবধানের জন্য কমরেডদের একটি নিরাপত্তা টিম, চিকিৎসা ও জীবনযাত্রার মান সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। যদিও এ সময় তিনি তাঁর সাধারণ দায়িত্বাবলী ধারণ করতে সক্ষম ছিলেন না, তথাপি তিনি তথ্য অধিদপ্তরের সাথে ঘনিষ্ঠ সংযোগ রাখতেন এবং মাঝে মাঝে এর কার্যক্রম সম্পর্কে পরামর্শ দিতেন। শরীরের এ অবস্থায়ও তিনি খবর শোনার জন্য ভোরে উঠতেন। নভেম্বর, ২০০৯-এ মেগুইন্দানাওয়ে কয়েকজন সংবাদদাতার মৃত্যু সম্পর্কে এবং সাংবাদিক হত্যার বিষয়ে তিনি গভীর মনোযোগ দিয়েছিলেন।
কমরেড কা রজার ছিলেন নিপীড়িত জনগণের মুক্তিসংগ্রামের আদর্শ সৈনিক, নির্ভীক যোদ্ধা, নমনীয় সংগঠক, শক্তিশালী পার্টি প্রচারক। জনগণের আগ্রহশীল অনুভূতিকে নাড়া দিয়ে বিপ্লবী জনজাগরণ সৃষ্টি করতে রসালো কৌতুকের প্রয়োগ ছিল তাঁর বিশেষ গুণেরই পরিচায়ক। এছাড়াও দৈনন্দিন চলমান ইস্যুতে তাঁর স্পষ্ট বিশ্লেষণ এবং ভাষার ব্যবহার ছিল যথেষ্ট জনবোধ্য। এজন্য তিনি সাধারণ পাঠক-শ্রোতাদের নিকটও ছিলেন আকর্ষণীয়, গ্রহণীয় ও প্রশংসিত।
বিশেষত কমরেড কা রজার ফিলিপাইনি যুব সমাজের নিকট ছিলেন বিপ্লবী অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি শাসক শ্রেণীর মিথ্যা প্রচারণায় বিভ্রান্ত না হয়ে অধ্যয়ন, বৈজ্ঞানিক-পরীক্ষা, পাশাপাশি জনগণের সাথে মিশে ফিলিপাইনি সমাজ বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে সঠিক জ্ঞান লাভের পথ দেখাতেন। যা ছিল ছাত্র-যুবদের শ্রমিক-কৃষকের সাথে একাত্ম হওয়ার ভিত্তি।
কা রজার কখনও মিথ্যা বিবৃতি দেননি, বিকৃত বিষয় এবং ভুল পরিসংখ্যান দেননি। তাই তিনি কখনও তাঁর প্রকাশিত বক্তব্য ফিরিয়ে নেননি। যথাসময়ে জনগণ এবং গণমাধ্যম প্রমাণ করতে পারতেন যে তাঁর কথা সত্য এবং যাচাইযোগ্য। সমাজে যেখানে রসালো এবং স্পর্শকাতর নাটকীয়তাপূর্ণ সংবাদ হচ্ছে প্রধান প্রবণতা, কা রজার সেখানে নিপীড়িত জনগণের বাস্তব জীবন-নাটক তুলে ধরে বিপ্লবী উদ্দীপনা সৃষ্টি করার যুদ্ধ করেছেন। শুধুমাত্র জনগণের কাছে “বিপ্লবের শুভ বারতা”পৌঁছে দেয়ার জন্য আক্ষরিক অর্থেই তিনি সুউচ্চ ও খাড়া পর্বতমালা আরোহণ করেছেন, সুগভীর নদী ও উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়েছেন এবং শত্রু’র অসংখ্য আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছেন।

About andolonpotrika

আন্দোলন বুলেটিনটি হলো বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন ও বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের একটি অনিয়মিত মুখপত্র
This entry was posted in আন্দোলন ১১. Bookmark the permalink.

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s