বুর্জোয়া রাজনীতিতে একটি বিতর্ক এখন তুঙ্গে। দলীয় সরকার, নাকি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে বুর্জোয়া শাসক শ্রেণী এখন তীব্র দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং কামড়া-কামড়িতে লিপ্ত। বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন জোট জেহাদ ঘোষণা করেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল না করলে তারা নির্বাচনে যাবে না। এমনকি সময়সীমা বেঁধে দিয়ে সরকার পতনের আল্টিমেটামও তারা দিয়েছে। আর মহাজোট সরকারও বিরোধী জোটের কর্মসূচী বানচাল করতে পুলিশ-প্রশাসন ও দলীয় কেডারদেরসহ সমস্ত ক্ষমতার ব্যবহার ও অপব্যবহার করছে। ১২ মার্চ বিএনপি জোটের কর্মসূচী বানচাল করতে সরকার নিজেই সারাদেশে হরতাল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল যা সাম্প্রতিক কালের নজিরবিহীন ঘটনা। শাসক শ্রেণীর বুর্জোয়া দলগুলোর এই নর্তন-কুর্দন, দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জনগণের যে বিন্দুমাত্র স্বার্থ নেই তা সরকার এবং সরকার বিরোধী বুর্জোয়া দলগুলোর বিগত কর্মকান্ড থেকে পরিস্কার।
আওয়ামী-মহাজোট সরকারের দেশ ও গণবিরোধী কর্মসূচি এবং রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিএনপি-জামাত জোট কার্যতঃ শক্ত কোন সংগ্রামী কর্মসূচি এ পর্যন্ত গ্রহণ করেনি। সরকার বিরোধী জনমতকে নিজেদের পক্ষে আনার জন্য শুধু বড় বড় হম্বিতম্বি করছে। তারা কিছুটা আন্দোলন করেছে, হরতাল ডেকেছে সংসদের সামনের সারিতে বেশী সিট পাওয়ার জন্য, খালেদা জিয়ার মঈনুল হক রোডের বাড়ী রক্ষার জন্য, তার ছেলেদের নামে মামলা এবং জামাত নেতাদের নামে মামলা প্রত্যাহারের জন্য। এই সব ইস্যুর সাথে জনগণের কিছু ইস্যু জুড়ে দিয়েছে মাত্র, যা তাদের মূল কর্মসূচি নয়।
মহাজোটের শরিক দল ক্ষমতার হালুয়া-রুটির ভাগ পাওয়া স্বৈরাচারী এরশাদ ও তার জাতীয় পার্টি ভারত ও সরকার বিরোধী জনমত তাদের পক্ষে আনার অপচেষ্টা করছে। মাঝে মধ্যে সরকার বিরোধী বক্তব্য দিয়ে চমক সৃষ্টি করছে। ভারত বিরোধী মিছিল করছে এবং একক নির্বাচন করার কথা বলছে। এতে দুটো কাজ এরশাদ করছে (এক) হাসিনাকে হুমকি দিয়ে সুবিধা আদায় করা; (দুই) সুযোগ বুঝে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করে ক্ষমতার বড় ভাগটা হাতিয়ে নেয়ার আশায় মাছ খেকো বকের মত এক পায়ে দাড়িয়ে তীক্ষ নজর রাখা।
আসলে শ্রমিক-কৃষক ও নিপীড়িত জনগণকে শোষণ-নিপীড়নে শাসক শ্রেণীর সকল গোষ্ঠিই এক ও অভিন্ন। শাসক শ্রেণীর বিভিন্ন গোষ্ঠির মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাত হচ্ছে তাদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে ক্ষমতার বড় ভাগটা দখলে রাখতে মরিয়া। তারা ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে উচ্চ আদালতে এবং সংসদের মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে। এখন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার ফতোয়া তারা জারী করেছে। সরকার বিরোধী অপর গোষ্ঠি বিএনপি জোট এটা মানতে নারাজ। কারণ এমন হলে তাদের ক্ষমতার বড় ভাগটা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে শাসক শ্রেণীর মধ্যে দ্বন্দ্ব এখন তুঙ্গে। জনগণ আরো একটি ১/১১-এর আতঙ্কে আতঙ্কিত। শাসক শ্রেণীর এটি একটি সংকটও বটে।
সাম্রাজ্যবাদ এবং শাসক শ্রেণীর সুশীলরা এ সংকট উত্তরণে জাতীয় ঐকমত্যের শ্লোগান তুলে গলদঘর্ম। মার্কিন কর্মকর্তারা ঘন ঘন বাংলাদেশ সফর করছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনা অতিমাত্রায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তারা বিভিন্ন পরামর্শ নির্দেশ চাপ প্রদান করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও বসে নেই। ভারত-তো বটেই। কিন্তু শাসকশ্রেণীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এতটাই তীব্র যে সমঝোতা খুব কঠিন দেখা যাচ্ছে। শাসক শ্রেণীর এই সংকট শ্রমিক-কৃষকসহ সাধারণ জনগণের জন্যও বর্ধিত কষ্টের সৃষ্টি করে। একই সাথে তা তাদের এই শত্রুদের চিনবার ও তাদের বর্জন করে, তাদের প্রতি মোহকে ঝেড়ে ফেলে নিজেদের পথে চলার সুযোগও সৃষ্টি করে।
সাম্রাজ্যবাদ এবং সুশীলদের চাপ সত্বেও বুর্জোয়া দলগুলো সহজেই তাদের গোষ্ঠিগত সুবিধাটা সহজেই ছাড়তে নারাজ। তাই একদিকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার তাদের সকল অপকর্ম আড়াল করতে “যুদ্ধাপরাধীদের বিচার” শোরগোল তোলে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠি এই অপরাধীদের বাঁচাবার চেষ্টা করে বলে অভিযোগ করে। অন্যদিকে খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে আন্দোলনকে কেন্দ্রীভূত করে জনগণের সমস্ত ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে ধামাচাপা দিচ্ছে। যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন হলেই জনগণের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
আসলে বুর্জোয়া জাতীয় নির্বাচন হচ্ছে শাসক শ্রেণীর মধ্যে ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারা করার একটা পন্থা মাত্র। জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আগামী পাঁচ বছর শাসক শ্রেণীর কোন গোষ্ঠি ক্ষমতার বড় ভাগটা পেয়ে সরকার গঠন করবে এবং জনগণকে শোষণ-নির্যাতন করবে তারই প্রতিযোগিতা। ক্ষমতাসীন সরকারী দল চায় ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে ক্ষমতার বড় ভাগটা দখলে রাখতে। আর সরকার বহির্ভূতরা চায় সরকারের প্রভাবমুক্ত নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে জনরোষকে পুঁজি করে ক্ষমতার বড় ভাগটা দখল করতে। যা তারা করে বুর্জোয়া ভোটবাজী ‘গণতন্ত্রের’ নামে।
যে বিএনপি, যে খালেদা আজ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য জেহাদ ঘোষণা করছে। তারাই ১৯৯৬ সালে এর বিরোধিতা করেছিল এবং ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দলীয়করণ করার ষড়যন্ত্র এঁটেছিল। আর আজকের আওয়ামী সরকার, যে নাকি বিগত সেনা শিখন্ডী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভয় দেখিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার ফতোয়া দিচ্ছে, সেই আওয়ামী লীগই তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনার মহান অবদান বলে বাজার মাত করেছিল। আর ২০০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দলীয় প্রভাব মুক্ত করতে লগি-বৈঠা নিয়ে জেহাদ করে ১/১১-এর জন্ম দিয়েছিল এবং ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন সরকার তাদের আন্দোলনের ফসল বলে বেহায়ার হাসি হেসেছিল।
বুর্জোয়া নির্বাচন এলেই শাসক শ্রেণীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব-সংঘাত, কোন্দল, কামড়াকামড়ি বেড়ে যায়। বিগত ২০/২২ বছর ধরে বুর্জোয়া এ অপসংস্কৃতি জনগণকে কুরেকুরে খাচ্ছে। জনগণ এর শিকার হচ্ছেন। এরা পরস্পরের মুখোশ নিজেরাই উন্মোচন করছে অত্যন্ত নগ্নভাবে। উদ্দেশ্য একটাই সাম্রাজ্যবাদের আশীর্বাদ নিয়ে ক্ষমতার বড় ভাগটা দখল করে সরকার গঠন করা। জনগণের সম্পদ লুটপাট করে আত্মসাৎ করা। শোষণ করা। কোটি কোটি টাকা, গাড়ী, বাড়ীর মালিক হওয়া। বিগত ৪০ বছর ক্ষমতার পালা বদল করে শাসক শ্রেণীর সকল গোষ্ঠি এই কাজটিই করে চলেছে।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে যে দলই ক্ষমতায় গিয়ে সরকার গঠন করুক না কেন, হোক তা দলীয় সরকারের, বা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে, তাতে শ্রমিক-কৃষক-নিপীড়িত জনগণের কোনই লাভ হবে না। এই নির্বাচিত সরকার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, আমলা-মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের স্বার্থ রক্ষা করবে। নিজেরা মোটা অঙ্কের কমিশন পাবে, ঘুষ-দুর্নীতি চালাবে। বাড়ী ভাড়া, পরিবহণ ভাড়া, নিত্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে আগের মতই। বিচার বহির্ভূত হত্যা, গুম হত্যা বন্ধ হবে না। নারী নিপীড়ন, খুন, ধর্ষণ বন্ধ হবে না। অর্থাৎ শাসক শ্রেণীর সকল গণবিরোধী তৎপরতা অব্যাহত থাকবে। এটা সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার অমোঘ নিয়ম।
আজ নির্বাচন প্রশ্নে শ্রমিক-কৃষক-নারীসহ সর্বস্তরের নিপীড়িত জনগণের আশু করণীয় হচ্ছে বুর্জোয়া রাজনীতি ও নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করে তার বলয় থেকে বেরিয়ে আসা। শ্রমিক শ্রেণীর আদর্শে বিপ্লবী রাজনীতি আঁকড়ে ধরা। বিপ্লবী আন্দোলনকে বেগবান করা। সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম-এর লক্ষ্যে জনগণের শত্রু শ্রেণীর সকল গোষ্ঠি ও তাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে নয়াগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। কেবলমাত্র এমন একটি ব্যবস্থাই শ্রমিক-কৃষক-নারী-আদিবাসী-সাধারণ মধ্যবিত্তসহ নিপীড়িত জনগণকে বুর্জোয়া শাসন ব্যবস্থার জগদ্দল পাথর থেকে মুক্তি দিতে পারে। জনগণকে বিকল্প পথ হিসেবে বিপ্লবকেই বেছে নিতে হবে।
-
সাম্প্রতিক লেখা
সংগ্রহ
বিষয়
-
Join 6 other subscribers
Blogroll
Top Clicks
- None