কমরেড কা রজার ১৯৪৭ সালের ১৯ এপ্রিল ফিলিপাইনের বাতাঙ্গাসের আইব্যান শহরের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা পাভলো রজাল এবং মা ক্রিসপিনা ক্রুসাট একটি ছোট ইক্ষু খামারে মজুরের কাজ করতেন। অভাবের কারণে মাধ্যমিক স্কুলে পড়ার সময়ই তাঁকে স্কুল ছাড়তে হয়। ফলে কা রজার খুব অল্প বয়সেই জনজীবনের দুঃখ-কষ্ট ও সংগ্রামের তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তিনি পরিবারকে আর্থিকভাবে সহযোগিতার জন্য বাসন-কোসন, মশারী ও অন্যান্য পরিধেয় ফেরি করে বিক্রি করতে থাকেন।
এ সময় প্রথমে কিছুদিন তিনি একটি আখ-খামারের ট্রেড ইউনিয়নের সংগঠক হিসেবে কাজ করেন। পরে ফিলিপাইনি ছাত্র-যুব বিপ্লবীদের একটি গ্রুপে যুক্ত হন।
১৯৭২ সালে তিনি স্বৈরাচারী ফার্দিনান্দ মার্কোসের সামরিক শাসনের সময় গ্রেফতার হন এবং একমাস পর লাগুনার ব্যানলাবাঙের ভিসেন্টি ক্যাম্প থেকে অন্যান্য রাজবন্দীদের সাথে পালিয়ে আসেন। তাঁর এই বীরত্বব্যঞ্জক জেল পলায়ন বিপ্লবী ও মার্কোসের স্বৈরশাসন বিরোধী জেলবন্দীদের আন্দোলনে ব্যাপক অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। যা ফ্রান্সের পেভেলিয়ন স্কোয়াডের মহাপলায়নের বীরগাঁথার মতো বড় ধরনের বীরগাঁথা হিসেবে আলোচিত।
বিপ্লবী দাম্পত্য জীবন
কমরেড কা রজারের জীবন কষ্ট ও ত্যাগে পরিপূর্ণ। তাঁর স্ত্রী কা সলি-ও একজন বিপ্লবী ছিলেন। তিনি ২০১১ সালের প্রথম দিকে ফিলিপাইনের মাওবাদী দমনে নিয়োজিত সেনাবাহিনী (এএফপি)’র সাথে সংঘর্ষে শহীদ হন। তাঁরা দু’ জনেই জনগণ ও বিপ্লবের সেবায় ত্যাগের সচেতন কর্মপ্রকল্প গড়ে তুলেছিলেন। কা রজার এবং কা সলি দীর্ঘদিন একত্রে থাকতে পারেননি; বেশী সময় পরস্পর থেকে দূরেই থেকেছেন। তারও বেশি সময় ধরে পৃথকভাবে কাটিয়েছেন তাঁদের দু’ সন্তান থেকে। তাঁদের এই ত্যাগ ছিল উচ্চতম আদর্শের মহান লক্ষ্যে পৌঁছার চেতনায় পরিপূর্ণ। তাই, ইতিমধ্যে বহু বিপ্লবী পরিবারের মতো দু’ সন্তানই তাঁদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে গোপন বিপ্লবী আন্দোলনের সার্বক্ষণিক জীবনে আসাটা কা রজার এবং কা সলি’র জন্য এক মতাদর্শগত বিজয়, এক অমূল্য সম্মানজনক পুরস্কার।
ফিলিপাইন বিপ্লবে কা রজার
ছাত্রজীবনে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড করতে গিয়ে জেলে যাওয়া এবং জেল পালিয়ে এসে ফিলিপাইনের মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন গেরিলা অঞ্চল, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, গেরিলা রেডিও সম্প্রচার গড়ে তোলায় যেমন যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন, তেমনি রাষ্ট্র, সরকার, সেনাবাহিনীকে এড়িয়ে চলা ও উন্মোচন করেছেন অত্যন্ত দৃঢ়তা ও নৈপুণ্যের সাথে।
কোরাজন একুইনো’র “সামগ্রিক যুদ্ধ” পলিসি’র আওতায় মাওবাদী দমনাভিযানের তীব্রতার সময় কা রজারকে আত্মসমর্পণ করানোর টোপ হিসেবে রাষ্ট্রের ভাড়াটে বাহিনী তাঁর ৩ বছরের কন্যা আন্দ্রিয়া-কে অপহরণ করে। কিন্তু কা রজার নীতিতে অবিচল থাকেন। অবুঝ শিশুকে অপহরণ করে রাষ্ট্র্রই বরং বিশ্ববাসীর কাছে ফ্যাসিস্ট হিসেবে উন্মোচিত হয়।
২০০৬ সালের পর থেকে গুরুতর অসুস্থতার জন্য যখন তিনি কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারছিলেন না তখন সরকারী সেনাবাহিনীর লুজোন কমান্ডের প্রধান লে. জেনারেল রোনাল্ড ডেটাবালী তাঁকে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু তিনি তা শাসক শ্রেণীর ফাঁদ হিসেবে চিহ্নিত করে উন্মোচন করেন। এবং কঠোর গেরিলা জীবনে আমৃত্যু দৃঢ় থাকেন। উল্লেখ্যযে, প্রতিক্রিয়াশীল মিলিটারী তাদের ঘোষিত কমরেড রজারের মাথার দাম কখনই প্রত্যাহার করেনি।
কমরেড কা রজারের মৃত্যু-পরবর্তী পার্টির নেতৃত্বে বহুমাত্রিক, ব্যাপক তৎপরতা দেখিয়েছে একজন সত্যিকারের কমিউনিস্ট বিপ্লবীর মৃত্যু যেমন ক্ষতি, তেমনি তাঁর অনুসরণীয় আদর্শকে আঁকড়ে রাখতে পারলে তা আরও বেশি উচ্চমাত্রার সফলতা নিয়ে আসে।