চীনের মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবকালে তিয়েন আন মেন স্কয়ারে দাঁড়িয়ে রেডগার্ডদের সাক্ষাত দিচ্ছেন কমরেড মাওসেতুঙ। তারই রঙিন ছবি সম্বলিত প্রচ্ছদ দিয়ে উৎস পাবলিশার্স জানুয়ারি, ২০১২ একটি ১৬০ পৃষ্ঠার বই প্রকাশ করেছে। বইটির শিরোনাম ‘মাও বনাম আধুনিক সংশোধনবাদ; চে-ফিদেলের দ্বন্দ্ব ও মতবাদ, একটি আক্রমণ, একটি প্রত্যুত্তর’। মূল্য ১৭০ টাকা। বইটি লেখা হয়েছে সিপিবি’র বর্তমান পলিটব্যুরো সদস্য জনাব হায়দার আকবর খান রণো সম্পাদিত ‘কমরেড’ ম্যাগাজিন জানুয়ারি, ২০১১ দ্বিতীয় বর্ষ, প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত ভারতের সংশোধনবাদী পার্টি সিপিএম-এর মুখপত্র দৈনিক গণশক্তির সাংবাদিক ও মার্কসবাদী লেখক দাবীদার শ্রীমান শান্তনু দে’র “মাও বনাম মাওবাদ”শিরোনামে লেখা নিবন্ধের খন্ডন হিসেবে। লিখেছেন মাওবাদী বুদ্ধিজীবী শাহজাহান সরকার।
এই বইয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে কিভাবে শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবের বিজ্ঞান মার্কসবাদ-লেনিনবাদ থেকে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ-এ উন্নীত হয়েছে। এবং বর্তমান যুগে মাওবাদ গ্রহণ না করলে কেন বিপ্লবী থাকা যায় না। মাওবাদকে বিরোধিতা করতে গিয়ে কিভাবে সংশোধনবাদ আসে। ভারতের মাওবাদী গণযুদ্ধের উত্থানকে কিভাবে সংশোধনবাদীরা আক্রমণ করছে। একইসাথে নেপালের গণযুদ্ধ চলাকালীন যারা তাকে বিরোধিতা করেছে, তারা কিভাবে এখন প্রচন্ড-বাবুরামের নেতৃত্বে ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’ নামের সংশোধনবাদী অধঃপতনকে উর্ধে তুলে ধরছে। এ সকল সংশোধনবাদী অবস্থানকে আড়াল করার জন্য ব্যক্তি মাওসেতুঙ, চারু মজুমদারকে কখনও কখনও প্রশংসা করছে। কিন্তু মাওবাদ, গণযুদ্ধ ও মাওবাদীদের বিপ্লবী অনুশীলন সম্পর্কে মনগড়া মিথ্যাচার ও উন্মত্ত আক্রমণ করছে। সস্তা জনমত নেয়ার জন্য এ সকল সংশোধনবাদীরা কিউবা, উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনাম, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়া, এমনকি ভেনিজুয়েলার কাছ থেকে কমিউনিস্টদের শেখার নসিহত করেন। কিন্তু চীন বিপ্লব, চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব, নকশালবাড়ী অভ্যুত্থান, পেরু-নেপাল ভারত-ফিলিপাইনের মাওবাদী গণযুদ্ধ থেকে শেখার কথা বলেন না। নিজেরাও শেখেন না। উপরোক্ত বইটিতে লেখক এ সকল বিষয়ে তথ্য ও বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে মাওবাদের তত্ত্বগত সঠিকতা প্রমাণ করেছেন এবং ক্রুশ্চভীয় ধারার আধুনিক সংশোধনবাদীদের উন্মত্ত আক্রমণের বিজ্ঞানসম্মত খন্ডন করেছেন। যার মাধ্যমে দুই বাংলার মাওবাদী, বিপ্লবকামী প্রগতিশীল পাঠকগণ মতবাদ, মতবাদের বিকাশ, কমিউনিস্ট পার্টি, বিপ্লবী অনুশীলন, গণযুদ্ধ, মাওবাদ ও আধুনিক সংশোধনবাদের মধ্যকার তত্ত্বগত পার্থক্য সম্পর্কে ভাল ধারনা পাবেন। যা চলমান বিতর্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা রাখবে। কিউবা এবং চে-ফিদেলের দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে তত্ত্ব, তথ্য ও বিশ্লেষণ সহকারে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সকল পর্যায়ের পাঠকের জন্যই তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিউবাপন্থা বা চেবাদের ফেরীওয়ালাদের বিভ্রান্তি ছড়ানোর বিরুদ্ধে এটি একটি উপযুক্ত দলিল। তবে এ অংশে ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া এবং ভেনিজুয়েলা প্রশ্নে সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ থাকলে আরো সমৃদ্ধ হতো।
বইটি লিখতে গিয়ে লেখক পরিশ্রমী, দায়িত্বশীল অধ্যয়ন করেছেন। সঠিক তথ্য, উদ্ধৃতি উপস্থাপন করেছেন। তত্ত্ব ও বিশ্লেষণে মাওবাদী সঠিকতা বজায় রাখতে সচেষ্ট থেকেছেন। কিন্তু দীর্ঘ তত্ত্বগত উপস্থাপনা, বহু অধ্যায়, পয়েন্ট, বহু খুচরো বিষয়ে মতামত এবং কঠিন পুরনো শব্দ বা ভাষা ও বাক্য ব্যবহারের কারণে বইটি অনেকাংশে ভারী হয়ে গেছে। বিশেষত দর্শন প্রশ্নে বই-এর প্রথমে প্রায় ৬০ পৃষ্ঠা জুড়ে আলোচনা জটিল হয়েছে। সমগ্র রচনাটিকে এতটা দর্শন-ভারাক্রান্ত না করলেই বরং ভাল হতো। একইসাথে শান্তনু দে’র সংশোধনবাদকে খুব তীক্ষতার সাথে উদ্ঘাটন না হয়ে আলোচনা ছড়িয়ে গেছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে পুনরাবৃত্তিও ঘটেছে। এসব বইটির বড় দুর্বলতা।
এছাড়াও আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়েছে। যেমন, মাও মৃত্যু পরবর্তীকালে গণযুদ্ধ সম্পর্কে মাওবাদীদের উপলব্ধিও উচ্চতর স্তরে উন্নীত হয়, যা কিনা মতবাদেরই অংশ। গণযুদ্ধের বিশ্বজনীনতা মাওবাদের অংশ হিসেবে উল্লেখ করলেও এটা মাও পরবর্তী মাওবাদীদের উপলব্ধির বিকাশ হিসেবে আসেনি। এভাবে আরও আসেনি মাওচিন্তাধারা থেকে মাওবাদ সূত্রায়ন গ্রহণ, বিশ্ব কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের একটি নতুন আন্তর্জাতিকের ভ্রুণ কেন্দ্র হিসেবে রিম গঠন এবং এর ভূমিকা। যা মতবাদ বিকাশের অধ্যায়ে সংক্ষিপ্ত করে হলেও আলোচনা করা আবশ্যক ছিল। যা না করাতে এ বইয়ের মাওবাদ উপলব্ধি উচ্চতর অবস্থান থেকে তুলে ধরার ঘাটতি রয়ে গেল।
লেখক শান্তনু দে’র উত্থাপিত প্রসঙ্গের সূত্র ধরে খন্ডন করতে গিয়ে ভারতের সংশোধনবাদীদের কিছু উদাহরণ এনেছেন। কিন্তু এদের ঐতিহাসিক লাইনগত-মতাদর্শগত সমস্যা ভারত এবং আমাদের দেশে কিভাবে পড়েছে তা আসেনি। আমাদের দেশের মাওবাদ এবং সংশোধনবাদের মধ্যকার সংগ্রামের প্রশ্নটিও উহ্য থেকে গেছে। যা চলমান সংগ্রামের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এগুলোও কিছুটা আনলে ভাল হতো।
ভারতে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ প্রসঙ্গে খন্ডন করতে গিয়ে লেখক শুধু তত্ত্বগত গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছেন। অথচ ৮০/৯০ দশকে মাওবাদীরা হিন্দু মৌলবাদীদের রণবীর সেনাকে গণযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গ্রামাঞ্চল থেকে বিতাড়িত করেছেন। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম-এর মুসলিম নিপীড়নের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণআন্দোলনে সামিল হয়েছেন মাওবাদীরা। বাবরি মসজিদের রায়ের প্রশ্নে পত্রিকা সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাখ্যামূলক খন্ডন করেছেন মাওবাদী নেতা কমরেড গণপতি। তথ্য ও উদাহরণের অভাবে এ অধ্যায়টি প্রাণবন্ত হয়নি। নেপাল প্রশ্নে আন্তর্জাতিক মাওবাদী আরসিপি(আমেরিকা), পিবিএসপি(বাংলাদেশ), সিপিআই(মাওবাদী)/ভারত-এর লাইনগত সংগ্রামের মূল পয়েন্টগুলো উল্লেখ করলে ভাল হত।
সব মিলিয়ে বইটি বর্তমান সময়ে সমাজতন্ত্র-কমিউনিজমের সংগ্রামে নিয়োজিত কর্মী, সংগঠক, লেখক, বুদ্ধিজীবীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
-
সাম্প্রতিক লেখা
সংগ্রহ
বিষয়
-
Join 6 other subscribers
Blogroll
Top Clicks
- None