বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বাসদ-এর কেন্দ্রীয় স্তরে সম্প্রতি একটি ভাঙন ধরেছে। ৮-সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং বাসদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও একজন প্রবীন নেতা জনাব আবদুল্লাহ সরকার, এবং নবীন নেতা জনাব সাইফুর রহমান তপন প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে পার্টি থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন। তারা কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং পার্টির বিভিন্ন নীতি ও কার্যক্রমের বিরুদ্ধে বিবিধ অভিযোগ উত্থাপন করে লিখিত বিবৃতি দিয়েছেন (১ আগস্ট,’১০)। যার জবাব আবার কেন্দ্রের পক্ষ থেকে একটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করা হয়েছে (২৫ আগস্ট,’১০)। ‘বাসদ’ নিজেকে সমাজতান্ত্রিক দল, বা এমনকি সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লবী দল বলে দাবী করে। তবে এটি বাস্তবে প্রকৃত কোন কমিউনিস্ট বিপ্লবী পার্টি নয়, বরং একটি সমাজ-গণতন্ত্রী পার্টি। তা সত্ত্বেও বাম মহলে বাসদের সক্রিয় উপস্থিতি এবং বিপুল পরিমাণ মধ্যবিত্ত সমাজতন্ত্রমনা কর্মী ও সমর্থকের সমাবেশ এই পার্টিতে ঘটায় বাসদের মধ্যকার এই সমস্যা গুরুত্বের দাবী রাখে। অবশ্য পার্টি থেকে বিভক্ত সরকার ও তপন নিজেরা পৃথক কোন পার্টি বা সংগঠন করবেন বলে মনে হচ্ছে না, এবং তাই এই সমস্যা বাসদে বড় আকারে বিভক্তি বা সংকট সৃষ্টি না-ও করতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এর কিছু প্রাথমিক ও সংক্ষিপ্ত মার্কসবাদী মূল্যায়ন বাম কর্মী-সমর্থকদের কাজে লাগতে পারে।
* সরকার ও তপনের বক্তব্যে বাসদের বেশ কিছু নীতি ও কার্যক্রম সম্পর্কে প্রশ্ন ও সমালোচনা উত্থাপন করা হলেও মৌলিক কোন রাজনৈতিক-লাইনগত পার্থক্য প্রকাশিত হয়নি। বরং তারা নারী/পরিবার/যৌন প্রশ্নে এবং পাশাপাশি অর্থ বিষয়ে কিছু অভিযোগ ও প্রশ্ন এমনভাবে উত্থাপন করেছেন যা ব্যক্তিগত চরিত্রহনন বা কুৎসা প্রচারের পর্যায়ে পড়ে বলে প্রতীয়মান হয়। এবং শেষ পর্যন্ত এ সবই নারী/যৌন/বিবাহ-পরিবার প্রশ্নে সামাজিক পশ্চাদপদ দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধকে উসকানি দিয়ে নিজেদের ন্যায্যতা প্রতিপন্ন করতে চেয়েছে, যা কিনা প্রতিক্রিয়াশীল। তাদের যদি প্রকৃতই কোন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক-লাইনগত পার্থক্য থাকতো, যেজন্য তাদের বিভক্তি অপরিহার্য হয়ে উঠেছে, তাহলে তারা এ সব বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া নীচুতার আশ্রয় নিতেন না। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, কোন গুরুতর বিপ্লবী দায়বদ্ধতা থেকে তারা পার্টির সাথে এই বিচ্ছেদ করেননি। যদিও তাদের উত্থাপিত অনেক অভিযোগ সঠিক হতে পারে, কিন্তু সেসবের উৎস আরো অনেক দূরে ও গভীরে নিবদ্ধ। তারা যদি বিপ্লবী ও সমাজতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতেন তাহলে এসব প্রশ্নও ধাপে ধাপে তাদের কাছে পরিস্কার হয়ে উঠতো। সেটা একটা পর্যায় পর্যন্ত পার্টিতে থেকেও হতে পারতো, নতুবা পার্টির বাইরে গিয়ে। কিন্তু এ ধরনের দায়িত্বহীন বিভক্তি ও প্রচারে তারা যেতেন না। এসব বিষয়ে পার্টি-কেন্দ্র যে উত্তর দিয়েছে তাকে এই ভিন্নমতকারীগণ ফেলে দিতে পারবেন না। তাই, পার্টিকেও ‘ভুল’ পথ থেকে সরাতে তারা পারবেন না। বরং তারা নিজেরাই ‘অরাজনৈতিক’ জীবনে নিস্ত্রীয় হবার পশ্চাদপদ সুবিধাবাদী পথে চলে যাবেন। যেটা কোন নৈতিক পথ নয়। বাসদ পার্টির তথাকথিত অনৈতিকতা বা ত্রুটিগুলোকে বিরোধিতা করার জন্য সে পথটি কোনক্রমেই যুক্তিযুক্ত নয়। যদিও এসব ঘটনার সময়টাতেই জনাব সরকারের বাড়ীতে বাসদ কর্মীদের দ্বারা একটি হামলা হয় বলে পত্রিকায় খবর প্রকাশ পায়। তাতে তার কন্যা, জামাতা ও নাতনীর আহত হবার সংবাদ এসেছে, যাকে কোনক্রমেই নৈতিক বলা যাবে না। এ সম্পর্কে আমরা প্রকৃত তথ্য জানি না, বাসদের কোন আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়াও জানি না। তবে এ ধরনের ঘটনাকে যেকোন প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও বাম শক্তিই নিন্দা করবেন, এসব ইতর কর্মকান্ড থেকে কর্মীদের বিরত রাখবেন, কোন অন্যায় ঘটনা ঘটে থাকলে সেজন্য প্রকাশ্যে আত্মসমালোচনা করবেন মতপার্থক্য যত তীব্রই হোক না কেন। কারণ, এসবই প্রতিক্রিয়াশীল ধরণের কাজ, যাকিনা ক’রে থাকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি-রা। আমরা জানি না বাসদ কেন্দ্র এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
* একটি সর্বহারা বিপ্লবী পার্টি হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাসদের মূল সমস্যাগুলো কোথায় সেই আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। বরং এই বিতর্কে উঠে আসা সমস্যাবলীতে কীভাবে বাসদ পার্টি মার্কসবাদ অনুশীলনে ব্যর্থ হতে পারে বা হয়েছে সে আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকা যায়। তবে এর আলোচনায় স্বাভাবিকভাবেই তাদের সামগ্রিক লাইনগত সমস্যার কিছু আভাসও পাওয়া যাবে। যে সমস্যাগুলো উঠে এসেছে তার মাঝে দেখা যায় পেশাদার বিপ্লবী, তাদের পারিবারিক বিশেষত একান্ত ব্যক্তিগত জীবন, পার্টি-অফিস, পার্টি-সম্পদ, তহবিল, পার্টির মধ্যে মতপার্থক্য নিরসন তথা দুই লাইনের সংগ্রাম মীমাংসা ইত্যাদি বিষয়। এখানে প্রথমেই যে কথায় আসতে হয় তা হলো, বাসদ-যে বিদ্যমান রাষ্ট্র বিরোধী একটি বিপ্লবী পার্টি নয়, তা প্রকাশিত অনেক তথ্যে আরো বেশী করে প্রমাণিত হয়। তারা শত্রুর নাকের ডগায় কতগুলো অফিস, বাসা, মেস খুলে বসেছেন যেখানে তাদের প্রায় সকল কেন্দ্রীয় নেতা, গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও কেডারদেরকে তারা জড়ো করেছেন। তারা সেখানে থাকছেন, অফিস করছেন, জীবন কাটাচ্ছেন। প্রথমত কোন বিপ্লবী পার্টি এটা করতে পারে না। বিশেষত আমাদের মত একটি স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে। রাষ্ট্র ও বিপ্লবের শত্রুরা যদি তাদেরকে ধ্বংস করতে চায় তাহলে এই অফিস/পার্টি-বাসা/মেসগুলো ধ্বংস করাই যথেষ্ট। মনে হয় তারা এ আশংকায় নেই, সারা জনমের জন্য তারা ঠাঁই করে নিয়েছেন শত্রুর নাকের ডগায়, এবং ‘বিপ্লবী’র প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছেন। লেনিনের পার্টি কখনো এমনভাবে সংগঠিত ছিল না। মাও সেতুঙের গণযুদ্ধের পার্টি-তো নয়ই। এটা হয়েছে অনেকটা জামাতে ইসলামী যেমনটা করে থাকে সেরকম। তবে জামাত এর চেয়ে বেশী বেআইনী ধারায় নিজেদেরকে সংগঠিত করে। আপাতত একে একটি টেকনিক্যাল সমস্যা মনে হতে পারে, কিন্তু এ সমস্যা অনেক গভীরে নিহিত এবং অনেক সমস্যার তা জনকও বটে। পেশাদার বিপ্লবী কীভাবে গড়ে উঠবে, বা কাকে বলবো? পেশাদার বিপ্লবীর জন্য পারিবারিক নীতিটা কী? তার একান্ত ব্যক্তিগত জীবন কীভাবে সংগঠিত ও পরিচালিত হবে? তার সম্পদের প্রশ্নে তাদেরকে ও পার্টিকে কীভাবে শিক্ষিত করা হবে? বাসদ এসব সমস্যার কোন সঠিক সমাধান করেছে বলে মনে হয় না। বাসদ নেতাদের কারও কারও ত্যাগ খুবই প্রশংসনীয় হতে পারে। তারা তাদের ব্যক্তিগত সম্পদ পার্টিতে দান করে দিয়েছেন। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পদের এ বিষয়টা গুটিকয় নেতার বিষয় নয়। বহু কর্মী ও নেতা পেশাদার বিপ্লবী হতে চান যারা এখনই ব্যক্তিগত সম্পদের মালিকানা সম্পূর্ণ পার্টির হাতে তুলে দিতে না-ও চাইতে পারেন। এবং সেটা সম্ভব না-ও হতে পারে। ব্যাপক পার্টি-কর্মীদের জন্যও সেটা খাটে, যদিও সমস্যাটা ততটা প্রকট আকারে আসবে না যদি আপনি শ্রমিক শ্রেণী ও গরীব কৃষকের মাঝে পার্টির মূল ভিত্তিটা স্থাপন করেন। কিন্তু বাসদ সে ধরণের পার্টি নয়। সেক্ষেত্রে পার্টি কীভাবে কেডারদের সর্বহারাকরণকে এগিয়ে নেবে? তেমনি বিপ্লবের স্বার্থে বিয়ে, সন্তান নেয়া এসবকে কেউ কেউ ত্যাগ করতে পারেন, যা প্রশংসার দাবীদার। কিন্তু ব্যাপক বিপ্লবীর একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যার সমাধানও করতে হবে। পৃথিবীর অনেক বড় বড় বিপ্লবী বিয়ে করেছেন, সন্তান ধারণও করেছেন। যদিও অনেকে বিপ্লবের স্বার্থে ও প্রয়োজনে সে স্বার্থ ত্যাগও করেছেন। বর্তমানে সহজে জন্মনিয়ন্ত্রণ করতে পারার কারণে অনেক বিপ্লবী পার্টিই সন্তান ধারণ, লালন-পালনের সমস্যা থেকে মুক্ত থাকাকেও উৎসাহিত করছে। বাসদ পার্টি এসব সমস্যাও ভালভাবে সমাধান করেছে বলে মনে হয় না। পরিবার-বিয়ে-যৌন প্রশ্নে সামাজিক নৈতিকতাকে বিপ্লবীরা গ্রহণ করে না, এটা যেমন ঠিক, তেমনি নতুন বৈপ্লবিক নৈতিকতা বিকশিত করা, তাতে নেতা-কর্মী ও জনগণকে পর্যায়ক্রমে শিক্ষিত করাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাতে কেন্দ্রবিন্দু হবে বিপ্লবের স্বার্থ, বিপ্লবী সম্পর্ক, অগ্রসর প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি, বিশেষত নারী প্রশ্নে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি। জৈবিক প্রয়োজনকে ত্যাগ করা, আর নারী প্রশ্নে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়। বাসদ যে ধরনের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পার্টি, তার সামাজিক ভিত্তি যে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণী তার পক্ষে এই প্রশ্নে সামাজিক আধা-সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধকে খোলামেলা খন্ডন করাটা দুর্বল হতে বাধ্য। কাজে কাজেই সেখানে একদিকে থেকে যায় সামাজিক পশ্চাদপদ মূল্যবোধ, অন্যদিকে এর যা কিছু প্রতিস্থাপন তা হয় ব্যক্তি ত্যাগের মানবতাবাদী মতাদর্শ দ্বারা, অথবা কিছু ক্ষেত্রে বুর্জোয়া মূল্যবোধ দ্বারা। এগুলো প্রকৃত বিপ্লবী মূল্যবোধ ও নৈতিকতা বিকাশে বাধা হিসেবে আসে।
* বাসদ মাওবাদী নয়। সেকারণে তারা লেনিনবাদের নামে স্ট্যালিনের অনেক ত্রুটি/সীমাবদ্ধতাকেও ধারণ করে। স্ট্যালিনের মনোলিথিক পার্টি-ধারণা এমন একটি বিষয় যা পার্টি-প্রশ্নে প্রকাশ পেয়েছে দ্বন্দ্বমান উভয় পক্ষ থেকেই। মাওবাদ আমাদের শেখায় যে, স্ট্যালিন এ প্রশ্নে ভুল করেছিলেন এবং পার্টির অভ্যন্তরস্থ দ্বন্দ্ব অনেক সময়ই সঠিকভাবে মিমাংসা করতে পারেন নি। প্রশ্নটা এটা নয় যে, বাসদ পার্টির অভ্যন্তরে ভিন্নমতকে গণতন্ত্র দেয়নি। সেটা আমাদের পক্ষে বাইরে থেকে মূল্যায়ন করাও যায় না। কারণ, পার্টিতে ক্ষুদে বুর্জোয়া চিন্তাধারা প্রায়ই পার্টি-অভ্যন্তরস্থ গণতন্ত্র নিয়ে খুব উচ্চকন্ঠ চিৎকার পাড়ে। এটা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিকতা ও উদারনৈতিকতাকে ধারণ করে, সর্বহারা চেতনাকে নয়। জনাব সরকার ও তপনের মাঝে এটা থাকতে পারে। কিন্তু প্রশ্নটা হলো, পার্টিতে ভিন্নমত হবেই, দুই লাইনের সংগ্রাম হবেই। সেটা কীভাবে পরিচালনা করা হবে তা পার্টি গঠন, লাইন নির্মাণ/বিকাশসাধন ও নেতা-কর্মীদের পুনর্গঠনের মাধ্যমে নতুন স্তরে পার্টি-ঐক্যের জন্য খুবই মৌলিক বিষয়। মনোলিথিক পার্টি-ধারণা একে সঠিকভাবে ধরতে ব্যর্থ হয়। মাওবাদ গ্রহণ না করার কারণে বাসদ এই প্রশ্নে সঠিকভাবে এগোতে সক্ষম নয়। সুতরাং তারা পার্টি-অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র সাধ্যমত চর্চার চেষ্টা করলেও এতে সমস্যা থাকতে বাধ্য যা সরকার-তপনের সমস্যার হ্যান্ডলিং-এও প্রভাব ফেলতে পারে।
* সবশেষে সংক্ষেপে বলা উচিত যে, বাসদ কেন বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি হয়ে উঠতে পারে নি, ও পারে না, তা বুঝতে হলে বাসদ গঠনের রাজনৈতিক ইতিহাসটাকে ভালভাবে বুঝতে হবে। বাসদ গড়ে উঠেছিল জাসদ-এর ভেতরকার বাম অংশ দ্বারা যারা জাসদের ঐতিহ্যকে পূর্ণভাবে পরিহার করতে পারে নি। আর জাসদ গড়ে উঠেছিল ৭১-পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ভেতরকার সংগ্রামী মধ্যবিত্ত তরুণদের দ্বারা যারা আওয়ামী ধারার সাথে সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটায়নি। সুতরাং বাসদ ও তার রাজনীতি সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লবী ধারা কখনই হয়ে উঠতে পারেনি। এ কারণেই তারা মাওবাদকেও বোঝেন না, গ্রহণও করেন না। তাদের সমস্যাবলীকে তাদের মতাদর্শগত-রাজনৈতিক লাইনের এই মূল ভ্রান্তির বাইরে ফেলে বিচার করা যাবে না। অক্টোবর,’১০