৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর পার হচ্ছে। সকল রাজনৈতিক শক্তিসহ সচেতন জনগণ ৭১-কে নিয়ে ইতিহাস তর্পণ করছেন। এখন ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ, যারা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বকারী শক্তি বলে দাবী করে। তাই, তারা তাদের বানানো ইতিহাস মানুষকে বড় আয়তনে পুনরায় বয়ান করছে। যাতে সামিল হয়েছে বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশ। তাই সেই ইতিহাসের কিছু পুনপর্যালোচনা ও উদ্ঘাটন জনগণের সামনে, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের সামনে উপস্থাপন করা এবং প্রকৃত সত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা এ সময়ে উপযোগী হবে।
এদেশে যাকিছু ইতিহাস বিকৃতি ও মিথ্যা বিগত ৪০বছর ধরে চালানো হয়েছে তার সবচাইতে বড় ক্ষেত্র হলো ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এটা বললে অত্যুক্তি হবেনা। আর এই বিকৃত ইতিহাসের সর্বপ্রধান বিষয়টি হলো এই প্রচার যে, গুটিকয় রাজাকার ব্যতীত সমগ্র জাতি ’৭১-এর একক চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এবং শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। বাস্তবে এর চেয়ে বড় মিথ্যা আর কিছু হতে পারে না। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বুর্জোয়াদের প্রধানতম রাজনৈতিক ও সংগঠিত শক্তি ছিল আওয়ামী লীগ সন্দেহ নেই। কিন্তু কত-যে বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তি নিজ নিজ শ্রেণীগত অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ছিল তারও ইয়ত্ত্বা নেই। মুক্তিযুদ্ধে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ-তো ছিলই না, বরং আওয়ামী রাজনীতির সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভর বুর্জোয়া চরিত্রের কারণে সেটা হওয়াও সম্ভব ছিলনা। ’৭১-এর চেতনা বলে কোন একক চেতনাও কখনো ছিল না ও নেই। এই চেতনা সর্বদাই বিভক্ত, বিপরীতধর্মী শ্রেণী চরিত্র অনুযায়ী ভিন্ন রকমের।
প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভক্তিটা ছিল শ্রমিক-কৃষক-দরিদ্র জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিপ্লবী বামপন্থী আন্দোলন, যা মাওবাদী আন্দোলন নামে পরিচিত, বনাম বুর্জোয়া ও উঠতি বুর্জোয়া শ্রেণী স্বার্থ ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের পক্ষভুক্ত আওয়ামী নেতৃত্বের আন্দোলনের মাঝে। এটাই ছিল প্রধান দুটো দৃষ্টিভঙ্গি যা সরাসরি দুটো বিপরীত শ্রেণীচরিত্র থেকে এসেছিল।
কিন্তু খোদ আওয়ামী নেতৃত্বের আন্দোলনের মাঝেও ছিল ব্যাপক ও বহু ধরনের বিভক্তি। জাতীয়তাবাদী ও সংস্কারবাদী বাম যাদের এক ধরনের সর্বমান্য প্রতিনিধি ছিলেন মওলানা ভাসানী, তাদের সাথেও আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপক পার্থক্য ছিল। আর মস্কোপন্থী নামে যারা পরিচিত ছিলেন সেই আওয়ামী লেজুড় বামরা ছিলেন আরেক ধারা।
উপরন্তু আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিক রাজনীতির মধ্যেই ছিল হাজারো বিভক্তি। শেখ মুজিবকে হত্যার পর থেকে আওয়ামী নেতৃত্বই দাবী করে যে, প্রবাসী আওয়ামী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোশতাক মার্কিনের সাথে যোগসাজশে পাকিস্তানের সাথে একটি সমঝোতার রাজনীতি এনেছিলেন। ছিল বিদ্রোহী আর্মি থেকে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আওয়ামী রাজনীতির নেতৃত্বাধীন দ্বন্দ্ব। আওয়ামী লীগের মধ্যেও ছিল বিভিন্ন গ্রুপিং-লবিং যা মুক্তিযুদ্ধকে দেখা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে বিবিধ রাজনৈতিক পার্থক্য থেকেই এসেছিল।
উপরোক্ত প্রথম পার্থক্যটা বাদে বাকীগুলো যদিও তখন অল্প সময়ে তেমন একটা খোলাভাবে ভেসে উঠতে পারেনি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালেই এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রে পর্যন্ত এসবের প্রভাব পড়তে শুরু করেছিল। যুদ্ধ কিছুটা দীর্ঘায়িত হলে সুস্পষ্টভাবেই দেখা যেত যে, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ছিল বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ফলতঃ বিভিন্ন রাজনীতি ও অবস্থান।
সন্দেহ নেই উপরোক্ত সকলেই হানাদার ফ্যাসিস্ট পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে কম বা বেশী। কিন্তু সেটা তারা করেছে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে বহুবিধ রাজনৈতিক ধারার এই আধিক্য সৃষ্টি হয়েছিল প্রধান বুর্জোয়া শক্তি আওয়ামী লীগের নিজের কোন স্বাধীনতার ও স্বাধীন দেশের জন্য আর্থসামাজিক কর্মসূচী না থাকাতে। এমনকি ব্যক্তি শেখ মুজিবের নিজের কর্মসূচীও রহস্যাবৃত ছিল। সেটা এই তথ্য থেকেই বোঝা যাবে যে, তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি সচেতনভাবে।
এইযে বিভিন্নমুখী রাজনৈতিক কর্মসূচী ও ধারা মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে ক্রিয়াশীল ছিল তাকে মুছে ফেলার একটা চরম শক্তিশালী প্রচেষ্টা ৭১-এর পর বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসীন শাসক শ্রেণী, তার রাষ্ট্র ও পার্টিগুলোর পক্ষ থেকে হয়েছে। স্বভাবতই এই রাজনীতির গন্ডি অতিক্রম করতে যারা ব্যর্থ সেই বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত মধ্যবিত্তও বুঝে না বুঝে এই প্রচেষ্টায় সামিল হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে বিবিধ রাজনৈতিক মতধারা এদেশের বিভিন্ন শ্রেণীর রাজনীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রসূত ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালে বুর্জোয়া রাজনীতির কান্ডারী আওয়ামী লীগের ভূমিকা ও কর্মসূচীকে সমগ্র জাতির আশা-আকাংখা বলে প্রচার করার ও বিশ্বাস করার যে প্রাধান্যকারী চেতনা সেটা হলো সবচেয়ে গুরুতর বিভ্রান্তিমূলক বা মিথ্যা প্রচারণা। এদেশের শ্রমিক, কৃষক এমনকি বিপ্লবী মধ্যবিত্ত ব্যাপকভাবে আওয়ামী রাজনীতিতে ভেসে গেলেও এটাও সত্য যে এদের এক বিরাট অংশ ছিল তার প্রভাবের বাইরে। বিভিন্ন বিপ্লবী পার্টি বা মধ্যবিত্ত জাতীয়তাবাদী বাম রাজনীতির মাধ্যমে ও নেতৃত্বে ভিন্ন ধরণের মুক্তিযুদ্ধ ৭১-সাল ধরেই চালু ছিল।
স্বভাবতই বুর্জোয়া শ্রেণী, তার রাষ্ট্র ও বুদ্ধিজীবীরা যে ইতিহাস বয়ান করে ৭১-এর বহুবিধ বিষয় নিয়ে সেগুলো আংশিক, খন্ডিত, বিভ্রান্ত ও মিথ্যায় ভরপুর। এই বিভ্রান্তি ও মিথ্যার জগদ্দল পাথর সরিয়ে সত্য উদ্ঘাটন নির্মোহ গবেষকের কাজ, একইসাথে বিপ্লবী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বিশ্লেষণের বিষয়। আমরা চেষ্টা করবো মুক্তিযুদ্ধের ৪০-তম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে কয়েকটি নিবন্ধের মাধ্যমে ইতিহাসের কিছু মূল ও সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন প্রকাশ করতে। যাতে বিশেষত নবপ্রজন্ম বিগত ইতিহাসের মূল্যায়নে সঠিক ট্র্যাকে নিজেদের স্থাপন করতে কিছূটা সহায়তা পেতে পারেন।
৭১-এর ঘটনাবলী ও ইতিহাস বর্ণনা ও ব্যাখ্যায় সুস্পষ্টভাবে দুই শ্রেণী (একদিকে বুর্জোয়া, অন্যদিকে বিপ্লবী শ্রমিক রাজনীতির মাধ্যমে যা মূর্ত হয়) দৃষ্টিভঙ্গি ও দুই বিপরীতধর্মী অবস্থান যে রয়েছে সেটা বোঝাটাই এই প্রসঙ্গে ঢুকবার যাত্রাবিন্দু।
বিতর্কের ও মতবিরোধিতার অসংখ্য বিষয় রয়েছে। অসংখ্য সঠিক ত্যথ্যকে মাটিচাপা দেয়া হয়েছে। আর ইতিহাসের জঘন্য বিকৃতিসাধন করা হয়েছে। এই বিকৃতিসাধন তারাই সবেচেয়ে বেশী করেছে যারা অহর্নিশ ইতিহাস বিকৃতির জন্য অন্যকে দায়ী করে থাকে। আর আমাদের মধ্যবিত্ত ও বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীরা সেগুলোকে লুফে নিয়েছে। তারা পুস্তকের পর পুস্তক লিখছে, প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ লিখছে, কাল্পনিক যুদ্ধকাহিনী লিখছে এবং এসব করে তরুণ ও শিক্ষিত মানুষের মাঝে মিথ্যার এক বড় আস্তরণ ফেলে দিয়েছে। কিছু নগণ্য নিবন্ধ দিয়ে এর অপসারণ সম্ভব নয়। একটি বিপ্লবী আন্দোলনের শক্তিমান হয়ে ওঠার সাথে এটা জড়িত, যখন কিনা শ্রমিক ও কৃষক, সেই সাথে সাধারণ মধ্যবিত্ত, নিজেরা শ্রেণীগতভাবে সঠিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সংগঠিত হয়ে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জেগে উঠবেন, স্বশিক্ষিত হয়ে উঠবেন এবং বুর্জোয়া মিথ্যাগুলোকে নিজেদের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করে নেবেন। তবে সেই সচেতনতা, জাগরণ ও সংগঠন গঠনের জন্যও প্রয়োজন সচেতন ও মোহমুক্ত মহলে সত্যের প্রচার ও প্রসার। যা আবার অনেক প্রগতিশীল মানবদরদী বুদ্ধিজীবীকে সত্য উদ্ঘাটনে ব্রতী করবে এবং এই কাজকে এগিয়ে নেবে।
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন যে, ৭১ সালে পাকবাহিনী-রাজাকারদের গণহত্যাকালে, বুর্জোয়া নেতৃত্বের আপোষবাদীতা, সুবিধাবাদ ও প্রতারণার মুখে এবং সীমাহীন নির্যাতন ও অনিশ্চয়তার মুখে এদেশের জনগণ যে অসীম বীরত্ব, সাহস, ত্যাগ ও আত্মবলিদানের মধ্য দিয়ে পার হয়েছিলেন সেটা যে সম্পূর্ণই বৃথা গেছে সেটা আপামর জনগণ বোঝেন না তা নয়। তারা দেখেছেন তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। বুর্জোয়া শাসক, রাষ্ট্র ও বুদ্ধিজীবীরা এই সত্যকে ধামাচাপা দিতে চায় এই বলে যে, একটা ভূখন্ড, একটা দেশ, একটা পতাকা আর জাতীয় সঙ্গিত পাওয়া গেছে সেটাই বা কম কী?
আসলে এগুলো পাকিস্তান আমলেও ছিল। কেন তবে তা থেকে জনগণ বেরিয়ে এলেন? এজন্য যে, এইসব পতাকা আর সঙ্গীত তাদের ভাগ্যকে বদলায়নি। নিশ্চয়ই পাকিস্তান আমলেও কারো না কারো ভাগ্য ফিরেছিল, যেমন কিনা বাংলাদেশেও হয়েছে বড় জোর ১০% লোকের।
আরো যারা হিসেবী তারা দেখাতে চান যে, ৪০-বছরে প্রচুর উন্নতি কি হয়নি? এর উত্তরে তাদেরকে যদি প্রশ্ন করা হয় যে, বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলে দেশের এরকম ‘প্রচুর উন্নতি’ কি হয়নি তাহলে তার উত্তরে তারা কী বলবেন?
আসলে এই উন্নতি ধুয়ে জনগণ খাবেন না। এই উন্নতিতে ভাগ্য নিশ্চয়ই ৫-১০%-এর ফিরেছে। অন্যরা যে তিমিরে ছিলেন সেখানেই রয়েছেন।
এখান থেকে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য যে, যদি ৭১-সালের বাঙালী উঠতি বুর্জোয়ারা ও বুর্জোয়ারা একটি প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধই করে থাকে তাহলে এমনটা হবে কেন? পতাকা আর শাসকদের জাতীয়তা বদল ছাড়া আর কোন ক্ষেত্রে পাকিস্তান আমল থেকে দেশের জনগনের ভাগ্য বদলেছে?
এর উত্তর হলো এই শ্রেণী মুক্তিযুদ্ধ চায়নি, তার কোন প্রস্তুতি তাদের ছিল না, বাধ্য হয়ে যুদ্ধে নেমে তারা যা করেছে সেটা প্রৃকৃত মুক্তিযুদ্ধ ছিলনা, তারা দেশকে মুক্ত করেনি, দেশকে স্বাধীন করেনি। জনগণের মুক্তিযুদ্ধ ব্যর্থ হয়েছে সে কারণেই।
পরবর্তী নিবন্ধগুলোতে এসবকেই আমরা কিছুটা তুলে ধরতে চাইবো।