সংকটাপন্ন পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা : মুক্তি কোন পথে?

পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ী জাতিসত্ত্বার মাঝে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। এক গ্রুপের সাথে অন্য গ্রুপের বন্দুক যুদ্ধ, হতাহতের ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রায় প্রতিদিনই এ ধরনের খবর পত্রিকার পাতায় দেখা যায়। এ লেখা যখন তৈরী হচ্ছে তখন পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে রয়েছে। গত ১ মাসে এ ধরনের ঘটনায় শুধু রাঙামাটিতেই নিহত হয়েছে ১০ জনের অধিক। বাঙালী সেটলারদের সাথে আদিবাসীদের নিত্যদিন সংঘর্ষ ছাড়াও ‘ইউপিডিএফ-জেএসএস’, ‘জেএসএস সংস্কারপন্থী-সন্তু লারমা গ্রুপ’ প্রভৃতির মাঝে পরস্পর বন্দুকযুদ্ধ, বাড়ী বা বাজার থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা, গুম, অপহরণ, চাঁদা আদায় ইত্যাদি এখন স্বাভাবিক ব্যাপার।  এটাই চেয়েছে বাঙালী উগ্র জাতীয়তাবাদী শাসকশ্রেণী ও তাদের রাষ্ট্রযন্ত্র। পাহাড়ীদের মধ্যকার এই অন্তর্দ্বন্দ্বের ফায়দাটা লুটছে তারাই। পাহাড়ীদের মধ্যকার এই ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষের সুযোগে বাঙালী বড় ধনী শাসকশ্রেণীর বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে নানারকম প্রজেক্ট অর্থাৎ পাহাড়-জমি ও বনজ সম্পদ দখল তথা পার্বত্য এলাকা গ্রাস করার এক মহোৎসব চলছে। এর ফলে আজ পাহাড়ী জাতিসত্ত্বার জনগণ নিজ ভূমি থেকে প্রতিনিয়ত উচ্ছেদের ফলে তাদের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। এই পাহাড়ী জনগণ বিভিন্ন সময়ে তাদের উপর অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। কিন্তু সঠিক রাজনৈতিক দিশার অভাবে এসব বিদ্রোহ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। নিজেদের মধ্যে গ্রুপিং, ভাগাভাগি, দখল, মারামারি, খুন, রাহাজানিই হচ্ছে যার পরিণতি। ফলে আজ পাহাড়ী জাতিসত্ত্বার জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার তথা মুক্তির লক্ষ্যে তাদের আবারও নতুন করে ভাববার প্রয়োজন সৃষ্টি হয়েছে। পাহাড়ী জাতিসত্ত্বার জনগণ যুগ যুগ ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করে আসছেন। পাহাড়ী জনগণই পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি, অরণ্য ও সম্পদের প্রকৃত মালিক (দলিলপত্র থাক বা না থাক)। এই পাহাড়ীদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে আসছে বাঙালী বড় ধনী শাসক শ্রেণী ও রাষ্ট্র। রাজনৈতিকভাবে যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামাত প্রভৃতি। এসব কাজে তাদের প্রধানতম হাতিয়ার হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী এবং তারা এই নেতৃত্বদানের অন্যতম প্রধান পার্টিও বটে। এই ফ্যাসিস্ট উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছিল পাকিস্তান আমলে, গত শতকের ’৬০-এর দশকে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের মধ্য দিয়ে। সে অভিযান আজ বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ইত্যাদির মধ্যে সামান্য বিষয় নিয়ে কামড়াকামড়ি থাকলেও পাহাড় থেকে আদিবাসী জনগণকে উচ্ছেদ অভিযানে তাদের নীতি এক। এজন্যই বাঙালী শাসকেরা সমতলের ভূমিহীন নিঃস্ব জনগণকে পুনর্বাসনের নামে পাহাড়ে জমায়েত করছে। এখন সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে এই সেটলারদেরকে আদিবাসী জনগণের সাথে প্রতিনিয়ত সংঘর্ষে জড়ানো হচ্ছে। এভাবে পাহাড়ী বাঙালীদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে শাসকশ্রেণী তাদের লুটপাটের রাজত্বকে চিরস্থায়ী করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বাঙালী বড় বুর্জোয়া শাসক শ্রেণীর প্রতিনিধি শেখ মুজিব পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়ীদের বাঙালী হয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। যেজন্য গণবিরোধী ’৭২-এর সংবিধানে সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বা সমূহের (আদিবাসী) অধিকার সম্পর্কে একটি শব্দও নেই। তারপর থেকেই পাহাড়ী জাতিসত্ত্বার জনগণ তাদের মুক্তির লক্ষ্যে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেন। আজ ৪০ বছরে প্রমাণিত যে, সেই ত্যাগী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম ও তার রাজনীতি পরাজিত হয়েছে। জাতিসত্ত্বার প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনগুলো বহুধা বিভক্ত। তারা নির্বাচনের কানাগলিতে পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছে। পারস্পরিক সংঘাত চরম আকার ধারণ করেছে।  একই সময়ে গড়ে উঠা ভারতের ছত্তিশগড় বিহার লালগড় ঝাড়খন্ডে আদিবাসী জনগণের মুক্তির আন্দোলন অব্যাহতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ পাশাপাশি ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের আসাম মনিপুর নাগাল্যান্ড-এর জাতীয় আন্দোলন বিভ্রান্ত হয়ে একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। এগুলো কেন হচ্ছে তা গভীরভাবে ভাবতে হবে। তাই, এখন প্রয়োজন পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী জাতিসত্ত্বার সংগ্রামী উত্থান পরাজিত হওয়ার কারণগুলো বিশ্লেষণ ও সারসংকলন করা। তবেই সঠিক পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। ‘জনসংহতি সমিতি’র রাজনৈতিক ও সামরিক লাইনকে সুনির্দিষ্টভাবে পর্যালোচনা করা দরকার। এই সংগঠন বাঙালী বড় বুর্জোয়াদের জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেও তাদের রাজনীতি ও কর্মসূচী বিপ¬বী ছিল না। অন্যদিকে জেএসএস তথাকথিত শান্তি চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ী জাতিসত্ত্বার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার পর তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে গড়ে ওঠা ইউপিডিএফ-এর রাজনীতিও নতুন কোন বিপ্লবী দিশা দিতে পারে নি। জাতীয় বিশ্বাসঘাতক শান্তি চুক্তিকে বিরোধিতা ঠিক আছে। কিন্তু তা করে ইউপিডিএফ কি পুরনো জেএসএস-কেই আনতে চেয়েছিল? তাতে কোন নতুন বিপ¬বী কর্মসূচী আসেনি, আসতে পারে না। এছাড়া আরো যেসব গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে তাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। যদিও এদের মাঝে ব্যক্তিতগতভাবে কেউ কেউ বিপ্লবী আকাংখা পোষণ করেন। তাদের চলমান তৎপরতাকে তারা ভুল বলে স্বীকার করেও কার্যত একই জায়গায় অবস্থান করেন। আগের ঐতিহ্য থেকে পরিপূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটান না।  পার্বত্য এলাকায় তৎপর প্রতিটি সংগঠন/গ্রুপের মাঝে পরস্পরের বিরুদ্ধে ভ্রাতৃঘাতি কোন্দলে সরকার বা সেনাবাহিনীর বিভিন্ন অংশের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদ রয়েছে বলে প্রচার রয়েছে। কারণ, এতে বাঙালী বড় ধনী শ্রেণী ও তার রাষ্ট্রযন্ত্রের আসল উদ্দেশ্যই হাসিল হচ্ছে। এমনকি সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় নতুন নতুন সশস্ত্র গ্রুপ গড়ে উঠছে এমন তথ্যও আসছে। যা পাহাড়ীদের নিজেদের মাঝে মারামারি, হত্যা, উচ্ছেদ ইত্যাদিকে ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে তুলছে। এগুলোর ক্ষেত্রে সঠিক দিশা ও কর্মসূচী ব্যতীত পাহাড়ের আন্দোলন-সংগ্রাম সঠিকভাবে এগিয়ে যেতে পারে না। পাহাড়ী জনগণকে বাঙালী উগ্র জাতীয়তাবাদের বিপরীতে পাহাড়ী জাতীয়তাবাদের সমস্যাকে বুঝতে হবে। তাদেরকে বুঝতে হবে কেমন সমাজ তারা চান। এবং সেজন্য কোন মতবাদকে তাদের আঁকড়ে ধরতে হবে। সেজন্য সংগ্রামের কি ধরনের পদ্ধতি তাদের অনুসরণ করতে হবে। পাহাড়ে আমূল কোন বিপ্লবী রূপান্তর না ঘটিয়ে পাহাড়ী নব্য ও উঠতি বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে একটি পাহাড়ী সমাজ হলে তাতে ব্যাপক পাহাড়ী জনগণের কোন উপকার হবে কিনা। অথবা তাদের নেতৃত্বে আদৌ এমন একটি সমাজ গঠন সম্ভব কিনা। পাহাড়ী সংগ্রামীদেরকে আজ বুঝতে হবে বিদ্যমান বাংলাদেশী মুৎসুদ্দি শাসকশ্রেণী ও তাদের এ  রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধীনে কেন তাদের কোন মুক্তি সম্ভব নয়। এবং সাম্রাজ্যবাদকে উচ্ছেদ না করে, এবং তাদের দালাল ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের থেকে সমপূর্ণ বিচ্ছেদ না ঘটিয়ে কেন তাদের পৃথক কোন পাহাড়ী সমাজ গঠনও সম্ভব নয়। এজন্যই পাহাড়ী জনগণকে বিপ্লবের মতবাদ হিসেবে আঁকড়ে ধরতে হবে মাওবাদকে। বিশ্বব্যাপী কমিউনিজমের লক্ষ্যে ও সমাজতন্ত্রমুখীন নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে বর্তমানের কর্মসূচী হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। তার অধীনেই তাদের জাতিসমস্যার সমাধানের জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের কর্মসূচী আনতে হবে। সেজন্য একটি প্রকৃত মাওবাদী পার্টিতে সংগঠিত হতে হবে। মাওবাদী পথে সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। ভারতের লালগড়, ছত্তিশগড় আর ঝাড়খন্ড, অন্যদিকে নেপাল পেরুর প্রাক্তন মাওবাদী আন্দোলনে জাতিসমস্যার সমাধনে এবং প্রকৃত মুক্তির সফলতাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন প্রত্যয়ে নতুন পথে হাঁটতে হবে। নতুবা পাহাড়ী জাতিসত্ত্বা তার অস্তিত্ব ধ্বংসের সমূহ বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাবে না।                  ৩১ অক্টোবর,/২০১০

About andolonpotrika

আন্দোলন বুলেটিনটি হলো বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন ও বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের একটি অনিয়মিত মুখপত্র
This entry was posted in আন্দোলন ৭. Bookmark the permalink.

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s