বিগত কয়েক মাস ধরে আরব দেশগুলোর একটির পর আরেকটিতে যখন গণআন্দোলনের ঢেউ বয়ে যেতে শুরু করেছে তখন তার প্রভাব পড়ে লিবিয়াতেও। একই সাথে সবগুলো দেশে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো গণবিরোধী ও গণতন্ত্রবিরোধী ষড়যন্ত্রকেও বর্ধিত মাত্রা দেয়। কিন্তু লিবিয়ার ক্ষেত্রে এই ষড়যন্ত্র প্রকাশ্য সামরিক আগ্রাসনে রূপ নিয়েছে কেন তা বুঝতে হলে লিবিয়ার ৪ দশকের নেতা গাদ্দাফীর সাথে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের ঐতিহাসিক সম্পর্কটিকে বুঝতে হবে।
তিউনিসিয়া, মিশরের মত বিপুল সরকারবিরোধী গণআন্দোলন না ঘটলেও লিবিয়াতে দেখা গিয়েছে যে বেনগাজীসহ বেশ কিছু অংশে গাদ্দাফী বিরোধীরা ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিল। এইসব বিরোধীদের পিছনে কতটা গণসমর্থন ছিল আর গাদ্দাফী কী পরিমাণে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল সেটা পশ্চিমা বিশ্বের প্রচার থেকে আমরা বুঝতে পারবো না। গাদ্দাফী বিগত ৪০বছরের বেশী সময় ধরে একটি বুর্জোয়া-সামন্ততান্ত্রিক স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে। তাই, তার বিরুদ্ধে জনমত-বিক্ষোভ থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অন্যান্য আরব দেশগুলোর থেকে লিবিয়ার পার্থক্যও ছিল। শুধু গণআন্দোলন আর বিক্ষোভ দ্বারা দেশের প্রধান একটি শহরসহ অনেক অংশের ক্ষমতা দখল করা যায় না। এটা খুবই যুক্তিসঙ্গত অনুমান যে লিবিয়ায় ক্ষমতার মধ্যে থেকে একটি সামরিক ক্যুদেতা ঘটেছে। হতে পারে এটা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা অনুযায়ীই ঘটেছে। তারা বেনগাজীকে কেন্দ্র করে একটি অস্থায়ী সরকারও গঠন করেছে যা পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন পেয়ে চলছিল। পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমগুলো বিদ্রোহীদের সামরিক অভ্যুত্থানকে গোপন করার জন্য যে প্রচারটা দিয়েছে তাহলো বিক্ষোভকারীদের উপর গাদ্দাফী বিমান আক্রমণ চালাচ্ছে, নিরীহ লোক হত্যা করছে, তাদের বাঁচানোর জন্য তারা সেখানে হস্তক্ষেপ করছে। গাদ্দাফী কী করেছে তা পরিস্কার না হলেও এটা পরিস্কারভাবে বোঝা যায় যে, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী মদদপুষ্ট বিদ্রোহীরা একটা যুদ্ধ শুরু করেছে, আর গাদ্দাফী যুদ্ধের মাধ্যমেই তার জবাব দিচ্ছে।
লিবিয়া প্রথম থেকে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী লবির সাথে বিভিন্ন বিরোধে জড়িয়ে ছিল। ফলে লিবিয়ার মধ্যে জনগণের একটা বড় সমর্থন গাদ্দাফী ভোগ করতো। কিন্তু এটাও ঠিক যে, গাদ্দাফী কখনো সামগ্রিকভাবে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী শক্তি ছিল না। পশ্চিমাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে সে সোভিয়েত ব্লকে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদের পতনের পর সে পশ্চিমাদের সাথে আপোষ করেই নিজেকে রক্ষা করে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরাও মুখে গাদ্দাফীর প্রচন্ড বিরোধিতা দেখালেও তাদের মধ্যপ্রাচ্যস্থ বহু স্বার্থে, বিশেষত লিবিয়ার তেলের স্বার্থে গাদ্দাফীকে মেনেও নেয়। পরিবর্তিত অবস্থায় পশ্চিমা দেশগুলোতে গাদ্দাফী ও তার স্বজন ও ঘনিষ্ঠদের বহু কোটি টাকা ব্যাংকে থাকা ও বহু সম্পদের খবর থেকে স্পষ্টই দেখা যায় যে, গাদ্দাফীর দুর্নীতি ও বিপুল সম্পদকে রক্ষার ক্ষেত্রে খোদ পশ্চিমাদের মদদ ও সমর্থন ছিল।
আরব দেশগুলোতে স্বৈরতান্ত্রিক শাসকদের বিরুদ্ধে যখন ব্যাপক জনগণ আন্দোলনে জেগে উঠেছেন তখন সাম্রাজ্যবাদীরা সৌদী আরব, বাহরাইন, ইয়েমেনের চরম ফ্যাসিস্ট বাদশাহ ও শাসকদের মদদ দিয়ে চলেছে। আর যদিইবা কোথাও সরকার উৎখাতের পরিস্থিতি হয়ে যায় সেখানে তারা তাদের ভিন্ন মুখ এনে পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাচ্ছে। এজন্য দেখা যাচ্ছে যে, তারা মিশরে মোবারককে রক্ষার যারপরনাই চেষ্টা করেছে, যদিও সেখানে শত শত বিক্ষোভকারীকে হত্যা করা হয়েছে। অন্যদিকে সৌদি আরবকে দিয়ে বাহরাইনের বাদশাহকে রক্ষার জন্য সেনা অভিযান করেছে আরব লীগের বিরোধিতা সত্ত্বেও।
লিবিয়াতে পুতুল বিদ্রোহী সরকারের মাধ্যমে গাদ্দাফীকে উৎখাতের চেষ্টা স্পষ্টতই ব্যর্থ হবার উপক্রম হলে সাম্রজ্যবাদীরা যেকোন মূল্যে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের ছত্রছায়ায় ইরাকের মত এক সর্বাত্মক সামরিক আক্রমণ চালিয়েছে। তারা গাদ্দাফীর সামরিক বিজয়কে ঠেকাবার জন্য শঠতার সঙ্গে নো ফ্লাই জোনের বাহানা করে। নো ফ্লাই জোনের অর্থ হলো গাদ্দাফীকে ফ্লাই করতে দেয়া হবে না, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের ঘাতক বিমান ফ্লাই করবে। তারা বলছে নিরীহ বিক্ষোভকারীদের গাদ্দাফীর বিমান হামলা ও হত্যা থেকে বাঁচানোর জন্য তারা হস্তক্ষেপ করছে। অথচ প্রথম দিনের আক্রমণেই তারা দুইশতাধিক বেসামরিক জনগণকে হতাহত করেছে। অন্যদিকে মিশর, বাহরাইন, ইয়েমেনে তাদের দালাল সরকারগুলো যখন বেশুমার বিক্ষোভকারীকে হত্যা করেছে ও করছে তখন সেটা তাদের মদদ ও অনুমোদনেই হচ্ছে।
নিজেদের বিমান আক্রমণকে ন্যায্য করার জন্য ইরাক আক্রমণের মতই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তারা একটি
প্রস্তাব পাশ করিয়েছে। যদিও রাশিয়া, চীন, জার্মানসহ কয়েকটি দেশ এ প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। কিন্তু এইসব পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর নিজেদের দরকষাকষির সুযোগ রাখার জন্য তারা ভোট দানে বিরত থাকে। এভাবে একটি ছাড়পত্র নিয়েই তারা প্রকাশ্যে লিবিয়ার উপর আক্রমণ হানতে শুরু করেছে। যদিও অন্যদের চাপে কোন সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্ত তারা নিতে পারেনি, কিন্তু এটা পরিস্কার যে, পুতুল বিদ্রোহীদের ছত্রছায়ায় তারা সবধরণের আগ্রাসন চালাবে। এবং যদিই গাদ্দাফীকে উচ্ছেদ করতে না পারে, তাহলে সরাসরি সেনা পাঠানোর সম্ভাবনা রয়েছেই।
গাদ্দাফী কোন বিপ্লবী শাসনকে প্রতিনিধিত্ব করে না। তাই তার পক্ষে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনকে গণযুদ্ধের মাধ্যমে পরাজিত করা সম্ভব নয়। যদিও সে বলেছে অস্ত্রভান্ডার জনগণের জন্য খুলে দেয়া হবে, কিন্তু শুধু অস্ত্র দিয়েই গণযুদ্ধ হয় না। এজন্য বিপ্লবী রাজনৈতিক নেতৃত্ব লাগে, বিপ্লবী কর্মসূচী লাগে। সেটা গাদ্দাফীর নেই। তাই, একদিকে সে প্রতিরোধ যুদ্ধের কথা বলছে, অন্যদিকে আপোষের চেষ্টাও করছে। আর চেষ্টা চালাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদীদের নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করতে। ইতিমধ্যেই রাশিয়া কঠোর ভাষায় বিমান হামলার নিন্দা করেছে। চীন, ভারত বিরোধিতা করেছে। তবুও আপোষ হতে হলে সাম্রাজ্যবাদের কাছে ব্যাপক ছাড় দিয়েই গাদ্দাফীকে সেটা করতে হবে। নতুবা সাদ্দাম হোসেনের ভাগ্য বরণ করতে হবে। আপোষ হলেও সেটা প্রতিদ্বন্দ্বী সাম্রাজ্যবাদীদের চাপে এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষ থেকেও ছাড় দেবার ফলশ্রুতিতে হতে পারে।
তবে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের এই সামরিক আগ্রাসন শুধু লিবিয়াকে সামনে রেখে ঘটেছে তা ভাবলে ভুল হবে। আরব দেশগুলোর গণআন্দোলনকে দমনে যেমন তারা স্বৈরতান্ত্রিক সরকারগুলোকে সাহায্য করছে, কোথাও কোথাও প্রকাশ্যভাবে, তেমনি আন্দোলনকে ব্যবহার করে তারা সেসব দেশে নিজেদের স্বার্থ উপযোগী নতুন সেটআপ প্রতিষ্ঠা করতে সক্রিয় রয়েছে। তারা সৌদী আরব, বাহরাইনে সরাসরি গণআন্দোলনের বিরুদ্ধে সেনা নামানোকে মদদ দিচ্ছে। অন্যদিকে লিবিয়াতে আন্দোলনের পক্ষে থাকার ভান করে নিজেরাই সামরিক হস্তক্ষেপ করে অপছন্দের সরকারকে হটিয়ে সমৃদ্ধ তেল সম্পদের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করতে চাচ্ছে। আসলে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের শোষণের স্বর্গ আরব দেশগুলোতে নবগণউত্থানে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। সেজন্য তারা এই আক্রমণ দ্বারা এ অঞ্চলের জনগণকে ভয় দেখাতে চাচ্ছে। নিজেদের কর্তৃত্বের রাশ আঁটো করতে চাচ্ছে। সে লক্ষ্যেই তারা লিবিয়ায় আক্রমণ করেছে।
এগুলো তাদের মরিয়া হয়ে পড়ার সংকটকেও প্রকাশ করে। ইরাক, আফগানিস্তানে মার খাবার পর যখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আর কোন দেশে সামরিক আগ্রাসন চালানোর ক্ষেত্রে একটি বুড়ো বাঘে পরিণত হয়েছে, তখনও তারা লিবিয়াতে এই আগ্রাসনে বাধ্য-যে হয়েছে সেটা তাদের ঘনায়মান সমস্যাকেই প্রকাশ করছে। অন্যদিকে এই আগ্রাসন আন্তসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বকে আরো তীব্র করে তুলবে। রাশিয়া ও চীনের সাথে জার্মানীও যে এই আগ্রাসনের পক্ষে ভোট দেয়নি সেটা আগামীর বিশ্বে অনেক বেশী তাৎপর্যসম্পন্ন হবে। এমনকি বৃটেন ও মার্কিনের তোয়াক্কা না করে ফ্রান্স যেভাবে হঠকারীভাবে এগুতে চাইছে সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
সারা বিশ্বের মত আমাদের দেশেরও সকল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তির দায়িত্ব হলো লিবিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনকে বিরোধিতা করা। স্বৈরতন্ত্রবিরোধী গণআনেদালনের পক্ষে নামার কথা বলে সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতারণা ও বদমাইশীর মুখোশ উন্মোচন করা। আর জনগণের আন্দোলনকে একটি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মসূচীর ভিত্তিতে পরিচালনা করা।
আর সব দেশের মত লিবিয়াতেও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবসান, বুর্জোয়া শাসন ব্যবস্থার উচ্ছেদ ও জনগণের প্রকৃত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। এজন্য লিবিয়ার ভবিষ্যৎ লিবিয়ার জনগণই নির্ধারণ করবেন। কোন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও তাদের মাধ্যমে তাদের আরো অনুগত কোন পুতুল-ক্ষমতার মাধ্যমে লিবীয় জনগণের কোন উপকার হতে পারে না।
মার্কিন, ফ্রান্স, বৃটেনসহ সাম্রাজ্যবাদীরা অবিলম্বে লিবিয়া থেকে হাত গুটাও!