সেনাবাহিনীর অফিসারদের আবাসন প্রকল্পের নামে জোর করে নামমাত্র মূল্যে কৃষকের জমি ও ভিটেমাটি দখল করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রূপগঞ্জের কৃষক-জনগণ প্রচন্ড বিক্ষোভ ও বিদ্রোহে ফেটে পড়েন, যা গত ২৩ অক্টোবর গণঅভ্যূত্থানে রূপ নেয়। কানসাট ও ফুলবাড়ীর পর রূপগঞ্জের এই অভ্যূত্থান এদেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি ও রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বোঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রকাশিত খবরাখবর ও বিভিন্ন পক্ষের বিবৃতি-বক্তব্য থেকে যে সত্যগুলো বেরিয়ে এসেছে তাহলো ঢাকার অদূরে রূপগঞ্জে প্রায় ৭ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করে সেখানে সেনা-অফিসারদের জন্য হাউজিং প্রকল্প স্থাপনের একটা প্রক্রিয়া বেশ কিছুদিন যাবতই সক্রিয় ছিল। এ প্রকল্পের ব্যাপারে রাজউকেরও কোন অনুমোদন ছিল না (বিবিসি), যা কিনা যেকোন আবাসিক প্রকল্পের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক রাষ্ট্রীয় নিয়ম। এই অবৈধ কাজকে ধামাচাপা দেবার জন্য ঘটনার পর সেনাবাহিনী ও সরকারী লোকজন প্রচার করে যে, সেখানে সেনাসদস্যরা ব্যক্তিগতভাবে জমি কিনছিলেন। কিন্তু এই ‘ব্যক্তিগত’ জমি কেনার জন্য সেখানে কেন ৪টি সেনা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল এবং কেন সেই ‘ব্যক্তিগত’ কাজকে সেনাবাহিনীর শক্তি ও দাপটের জোর খাটিয়ে কার্যকর করছিল তার কোন জবাব নেই। অবশ্য একেও ধামাচাপা দেবার জন্য প্রশিক্ষণের জন্য সেনাক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল, এমন ভূয়া প্রচারও ক্ষীণকন্ঠে দেয়া হয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যেখানে জমির দাম বিঘাপ্রতি ৪০/৫০লক্ষ টাকা, সেখানে সেনাবাহিনীর জোর খাটিয়ে কৃষককে জমি-ভিটে বিক্রি করতে বাধ্য করা হচ্ছিল ১৫/১৬ লক্ষ টাকায়। সেটা কৃষকরা মানতে না চাইলে অন্য কোথাও জমি বেচা-কেনা অনানুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করে সেনাবাহিনী। আর স্থানীয় রেজিস্ট্রী অফিসে জমি-বেচাকেনার দলিল যাতে না হয় সেজন্য সেনারা লোক বসিয়ে রাখে। এ সবই স্থানীয় জনগণের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভের সৃষ্টি করে। এমনকি সেনাবাহিনীর অল্প কিছু দালাল আওয়ামী নেতা ও উর্ধতন নেতা বাদে আওয়ামী ও বিএনপি’র স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীরাও সেনাবাহিনীর এই জবরদস্তির বিরুদ্ধে জনতার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। ২৩ তারিখে এমনই এক প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে বিক্ষোভ ফেটে পড়ে। কিন্তু তা অভ্যূত্থানে রূপ নেয় যখন র্যাব-পুলিশ বিক্ষোভকারীদের উপর লাঠিপেটা শুরু করে ও গুলি করে। বিশেষত এক পর্যায়ে ক্যাম্পের সেনাবাহিনী যখন গুলি ক’রে কয়েকজনকে হত্যা করে ও লাশ গায়েব করে। এসব ঘটনায় অর্ধশত মানুষ হতাহত হন। এর প্রতিক্রিয়ায় জনগণের তীব্র ক্ষোভ ও উত্থানে ভীত হয়ে সেনাবাহিনী এক পর্যায়ে ক্যাম্প থেকে সরে যাবার পথ খুঁজে। কিন্তু সড়কপথে তা করতে ভয় পেয়ে ৭টি হেলিকপ্টার যোগে সেখান থেকে সরে যায়। জনতা সেনা ক্যাম্পগুলো আক্রমণ ক’রে জ্বালিয়ে দেন। তারা ঘোষণা করেন, এ এলাকায় সেনাবাহিনীর কোন আবাসিক প্রকল্প তারা হতে দেবেন না। এই হলো জনতার রায়। এই অভ্যূত্থান ও গণরায়ে ভীত ও বিপদগ্রস্থ হয়ে পড়ে সরকার, সেনাবাহিনী, শাসকশ্রেণী, তাদের রাজনৈতিক পার্টিগুলো ও রাষ্ট্রযন্ত্র। তারা তাদের প্রচার মাধ্যমে প্রচার করতে থাকে যে, কতিপয় কুচক্রী মহল নাকি সেনাবাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করানোর জন্য ষড়যন্ত্র করেছে। কিন্তু কে সেই কুচক্রী মহল? আওয়ামী লীগ দেখাতে চায় বিএনপি, জামাত এটা করেছে। আওয়ামী নেতারা বলেছে তথাকথিত যুদ্ধাপরাধী বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য নাকি এই ষড়যন্ত্র। আর বিএনপি বলতে চায় আওয়ামী সরকার সেনাবাহিনীকে কলূষিত করার ষড়যন্ত্র করছে। এরা সবাই যে হত্যা, গুম ও গণনির্যাতন, তথা কৃষক জনগণের ভিটে-মাটি ছাড়া করার ষড়যন্ত্রের মূল কারিগর সেনাবাহিনীকে রক্ষা করতে চাইছে তা খুবই পরিস্কার। কারণ হলো, এই সেনাবাহিনী এদের সবার। আর যদিও এরা বলে যে, এই সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ জনগণের বাহিনী, কিন্তু রূপগঞ্জের ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে আবার দেখিয়ে দিল যে, এই সেনাবাহিনী জনগণের তো নয়ই, বরং তারা জনগণের উপর নির্যাতনকারী, কৃষককে জমি-ভিটে থেকে উচ্ছেদকারী। রূপগঞ্জের এই অপরাধ, হত্যা ও নির্যাতনের জন্য সম্পুর্ণভাবে দায়ী করা যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। কারণ তিনিই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত। এখন খবর বেরিয়েছে যে, রূপগঞ্জের এই অবৈধ বেআইনী জবরদস্তিমূলক ভূমি দস্যুতার বিষয় আগেই প্রধানমন্ত্রীর দ্বারা অনুমোদিত ছিল। এবং তার চেয়েও বড় বিষয় হলো, যখন কিনা প্রতিটি রূপগঞ্জবাসী সেনাবাহিনীকে আবাসন করতে দেয়ার প্রশ্নে স্পষ্টভাবে না করে দিয়েছেন, সেখানে এই ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, এই গণবিরোধী প্রকল্প অব্যাহত থাকবে। প্রকল্পের প্রধান সেনাঅফিসারও দুদিন আগেই বিবিসি-কে একই কথা বলেছেন। কিন্তু নিহত জামালউদ্দিনের বোন সাংবাদিকদের বলেছেন, আমার ভাই যে জমির জন্য রক্ত দিয়েছেন, সেজন্য প্রয়োজনে আমিও রক্ত দেব, কিন্তু সেনাবাহিনীকে আমরা এক ইঞ্চি জমিও দেবো না। এটা আজ গুটিকয়েক দালাল ব্যতীত সকল রূপগঞ্জবাসীরই মনের কথা। তাই, সরকার ও সেনাবাহিনী নিয়েছে ফ্যাসিবাদী পথ। তারাই হত্যা করেছে, গুলি করেছে নিরস্ত্র মানুষের বুকে, অসংখ্য মানুষকে বর্বর নির্যাতন করেছে, সর্বোপরি কৃষক-জনগণের ভিটে-মাটি আর পেটের অন্ন জোগানো জমি লুট করে নিতে চেয়েছে, আবার তারাই এই জনগণের নামে কেস দাখিল করেছে। তিন চারটি মামলা ঠুকে দিয়ে কয়েক হাজার অজ্ঞাত মানুষকে আসামী করে জনগণকে বাড়িছাড়া করছে। এই বর্বরতাকে পরিপূর্ণভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছে আজ জনদরদী নামধারী হাসিনার আওয়ামী সরকার। গণমুখী সকল শক্তিকে আজ আওয়াজ তুলতে হবে জনগণের বিরুদ্ধে সকল মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে; ২৩ তারিখের হত্যার জন্য দায়ী সেনা ও র্যাব অফিসার ও সদস্যদের গ্রেফতার ও শাস্তি দিতে হবে; সেনা আবাসন তৈরীর নামে কৃষকের ভিটে-বাড়ি ও কৃষি জমি জবরদস্তি দখলদার সেনা অফিসার, দালাল ও আওয়ামী নেতাদের শাস্তি দিতে হবে। আজ শুধু রূপগঞ্জ নয়, ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর চারিপাশে এবং সারা দেশে অভিজাত আবাসিক প্রকল্পের নামে, বহুজাতিকদের শিল্প স্থাপনের নামে, খনি তৈরীর নামে, উন্নয়নের নামে কৃষি জমি দখলের এক মহোৎসব চলছে। সারা দেশের জনগণের উপর শোষণ করে, জনগণের সম্পদ লুন্ঠন করে, দেশের সম্পদ বিদেশের কাছে বিকিয়ে দেয়ার বিনিময়ে কিছু সংখ্যক লোক বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছে। তাদেরই স্বার্থে এসব হাউজিং প্রকল্প করা হচ্ছে। এর সাথে দেশের ৯০ ভাগ মানুষের স্বার্থের কোনই সম্পর্ক নেই। দেশের কোন প্রকৃত উন্নয়নই এগুলো নয়। বরং এসবের মধ্য দিয়ে কৃষক ও কৃষির ধ্বংস ছাড়াও পরিবেশের এক ভয়ংকর বিকৃতি ও বিনস্ট ঘটছে। বিপুল কৃষি ভিত্তিক মানুষ বেকার হয়ে শহরে ভীড় জমাচ্ছেন। এই সাম্রাজ্যবাদী ও মুৎসুদ্দী উন্নয়নের রাস্তাকে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ না করলে দেশের, জনগণের, কৃষির, পরিবেশের, নগর যানজটের, পানি-বিদ্যুত সমস্যার কোন সমাধান হবে না। তাই, আজ রূপগঞ্জের সংগ্রাম কোন বিচ্ছিন্ন সংগ্রাম নয়। রাষ্ট্র, সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ, সরকার, বুর্জোয়া রাজনেতিক দল এদের বর্বরতা ও গণবিরোধিতাও কোন আকস্মিক বিষয় নয়। তারা ধারাবাহিকভাবে এগুলো করে চলেছে। আর নিজেদেরকে গণদরদী আর দেশসেবক বলে চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে জনগণ সাহসী সব সংগ্রামও গড়ে তুলছেন। সারা দেশে জনগণের এইসব বহুবিধ ধরনের ও রূপের অনেক সংগ্রাম এবং খন্ড খন্ড ও স্থানিক অভ্যূত্থানকে একসূত্রে গ্রথীত করে এই গণবিরোধী ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করার বিপ্লবী সংগ্রামের পথেই শুধু কৃষকসহ সাধারণ মানুষের মুক্তি হতে পারে। ৩০ অক্টোবর,’১০
-
সাম্প্রতিক লেখা
সংগ্রহ
বিষয়
-
Join 6 other subscribers
Blogroll
Top Clicks
- None