বিশ্বকাপ ক্রিকেট, বুর্জোয়ারা যেভাবে খেলাকে সংগঠিত করে ও পরিচালনা করে

প্রায় দেড়/দুই মাস ধরে দেশে একটা ক্রিকেট উন্মাদণা সৃষ্টি হয়েছিল, যা অনেকাংশে সৃষ্টি করা হয়েছিল বললেও ভুল হবেনা। এটা ঠিক যে, মুৎসুদ্দী বুর্জোয়া ও তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের দ্বারা চালিত  এদেশের বিদ্যমান ব্যবস্থায় জনজীবনে বিশেষ কোন আনন্দ আর উৎসবের ব্যাপার যেখানে নেই, সেখানে উৎসব করার, আনন্দ করবার একটা আপাত সার্বজনীন উপলক্ষ পাওয়ামাত্র মানুষ তাকে লুফে নেন। ক্রিকেট নিয়েও কিছুটা তাই হয়েছে। এতে দোষের কিছু নেই। ক্রীড়া মানুষের সহজাত স্বভাবের মধ্যে রয়েছে এবং এর একটি সার্বজনীনতা রয়েছে। মানুষের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ও সৌন্দর্যের জন্য খেলা একটা অপরিহার্য উপাদানই বটে। কিন্তু এই ক্রীড়া-জোয়ার বিশ্বে ও দেশে যখন বুর্জোয়ারা সংগঠিত করে ও পরিচালনা করে তখন তা ব্যাপকভাবে তার সার্বজনীনতা হারায়। আর একে ঢাকবার জন্য শাসক, রাষ্ট্র, তাদের মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী ও প্রতিনিধিরা নিজেদের ভূমিকা ও অনুভূতিকে সার্বজনীনতার রং দেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও উন্মাদণা আসলে হয়ে পড়ে নির্দিষ্ট শ্রেণীর সম্পদ, এবং ব্যাপক জনগণের জন্য অনেকটাই আরোপিত। এবারের বিশ্বকাপ নিয়ে বাংলাদেশে যা হয়েছে তাকেও এর বাইরে ফেলা যাবে না।

বিশ্বকাপ আয়োজন কোনো একটা দেশের বিষয় নয়, কারণ এটা বিশ্বকাপ। কিন্তু ক্রিকেট এখনো পর্যন্ত বিশ্বজনীন খেলায় পরিণত না হওয়াতে মাত্র ১৪টি দেশের এই আয়োজনকেই বিশ্বকাপ নাম দেয়া হয়েছে। এর তুলনায় ফুটবল অনেক বেশী বিশ্বজনীন। ক্রিকেটের এই দুর্বল দশার কারণ নিহিত রয়েছে এর স্রষ্টা বৃটিশ উপনিবেশবাদীদের শ্রেণী চরিত্রের মধ্যে। প্রথমে তারা একে ৫/৬দিনের এক আয়েশী খেলা আকারে খেলতো। শোষক ভূস্বামী আর তাদের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের অফুরন্ত অবসর কাটানোর জন্য এটা মন্দ উপায় নয়। কিন্তু শ্রমজীবী জনগণের মধ্যে এর জনপ্রিয়তা পাবার প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু আজকের বিশ্বে এমন গণবিচ্ছিন্নভাবে কোন ক্রীড়া এগোলে তা থেকে যে মুনাফা হবার কথা তা কমে যেতে বাধ্য। তাই, আন্তর্জাতিক বুর্জোয়ারা একদিনের ক্রিকেট খেলা চালু করলো। এতে দর্শক বেড়েছে, খেলাটির জনপ্রিয়তা বেড়েছে। বুর্জোয়াদের মুনাফাও বেড়েছে। তবুও সারাদিন ধরে একটি খেলা দেখার ফুরসত ব্যাপক জনগোষ্ঠীর হতে পারে না। ফলে সারাদিনের ক্রিকেট দেখা ও উপভোগ করার উৎসব এখনো পর্যন্ত শ্রেণী হিসেবে বড়জোর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পর্যন্ত নামতে পেরেছে। শ্রমিক ও কৃষক যারা এদেশের ও বিশ্বের সবচাইতে বড় অংশ, তারা এ থেকে অনেক দুরেই রয়েছেন।

* শুরু থেকেই ক্রিকেটকে আধিপত্য করে রয়েছে দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বৃটেন ও অস্ট্রেলিয়া। ক্রিকেটেও তারা রাজনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের মতই নিপীড়ক, কর্তৃত্ববাদী ও শোষক।  সম্প্রতি ভারত তার বিরাট জনগোষ্ঠীর বাজারের কারণে সে কর্তৃত্বে অনেকটা ভাগ বসিয়েছে। নতুবা ওয়েস্ট ইন্ডিজ, দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান বা শ্রীলংকার মত যে দেশগুলো মাঠে যথেষ্ট দাপট দেখিয়েছে তারা প্রকৃত আধিপত্যের জায়গাটিতে ততটা পাত্তা পায়নি। তাই, বিশ্বায়নের যত শ্লোগানই দেয়া হোক না কেন, ক্রিকেট আয়োজনে এইসব দেশের কর্তৃত্ব ও দৃষ্টিকটু মাতব্বরী গোপন থাকে না ঠিক রাজনীতির মাঠের মতই।

ঠিক এ কারণেই এবারের বিশ্বকাপের আয়োজন থেকে পাকিস্তানকে বাদ দেয়াটা বর্তমানের ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান বিরোধী পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী ও তার দোসর ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের “সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ”-র রাজনীতির থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।

এটা ঠিক যে, পাকিস্তানে শ্রীলংকান টিমের উপর বছর দুয়েক আগে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছিল। কিন্তু এটা ঠিক কারা ঘটিয়েছিল সেটা এখনো রহস্যাবৃত। এমনকি এর পিছনে ‘র’-এর হাত রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছিল। এ ধরণের সন্ত্রাসী হামলা ভারতেও ঘটছে, আমেরিকাতেও ঘটছে। কিন্তু সেখানে খেলার আয়োজন বাতিল হয়না। তবে এ ধরনের হামলা তা সে যে-ই করুক, আজকের বিশ্বে নির্মল খেলাকে কোন পর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদীরা নিয়ে গেছে তার একটা ছোট নমুনাও বটে। পাকিস্তানের সেরা তিন খেলোয়াড়কে ঠিক এ সময়টাতেই নিষিদ্ধ করাটাও সামগ্রিক ষড়যন্ত্রের অংশ হলে তাতে অবাক হবার কিছু থাকবে না। এ ধরণের খেলা আন্তর্জাতিক বুর্জোয়াদের মুনাফা তৈরীর এক বড় ক্ষেত্র। স্বভাবতই এতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর পুজিঁর মধ্যে রয়েছে তীব্র কামড়াকামড়ি। মুনাফা ও প্রতিদ্বন্দ্বী পুজিঁকে ঠেকানোর জন্য তারা যেকোন অনৈতিক ও বেআইনী উপায়েরই আশ্রয় নিয়ে থাকে। বাস্তবে তাদের হাতেই খেলা পরিচালিত হয়। ঠিক এ কারণেই তারা অল্পবয়স্ক, অনেকক্ষেত্রেই কমশিক্ষিত, অমার্জিত খেলোয়াড়দেরকে বিরাট অংকের অর্থ ও অন্যান্য অনৈতিক প্রলোভনে ফেলে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায়। খেলোয়াড়রা তাদের হাতে দাবার বোড়ের মত কাজ করে। ডোপ কেলেংকারী আর ম্যাচ ফিক্সিং বুর্জোয়া পরিচালনায় খেলার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর অল্পই প্রকাশিত হয়, বেশীর ভাগই গোপন থাকে।

এইসব বুর্জোয়াদের বিপুল অবিশ্বাস্য অর্থেরই একটা অংশ পায় খেলোয়াড়রা। আর তাতেই তাদের একটা ক্ষুদ্র অংশ নিজেরাও বুর্জোয়া হয়ে যায়। তথাপি খেলোয়াড়রা ব্যাপকভাবে এই পিছনের অর্থশালীদের হাতের পুতুলই বটে। খেলোয়াড়দের এবং খেলা আয়োজনের অর্থ যতনা আসে প্রকৃত খেলার আয় থেকে, তার চেয়ে বহুগুণ আসে খেলাকে ব্যবহার করে যে বড় কোম্পানীগুলো বিজ্ঞাপনের মেলা বসায় তাদের প্রদেয় অর্থ থেকে। এছাড়া নামী খেলোয়াড়রা নিজেরা আজকাল বিজ্ঞাপনের মডেল হয়েও বড় অর্থ কামাচ্ছে। তাই, অর্থের মূল জোগানদাররাই যে খেলাকে নিয়ন্ত্রণ করবে তা বলাই বাহুল্য।

এ থেকেই তাদের কেউ কেউ খেলাকে নিয়ে শত শত কোটি টাকার জুয়ার আসর বসায়। এর স্বার্থে তারা খেলা গড়াপিটা করে। ম্যাচ ফিক্সিং আর ঘুষ খাওয়ার অপরাধে যে খেলোয়াড়রা নিষিদ্ধ হয় তারা শুধু বলির পাঠামাত্র। দেশের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা বা এ জাতীয় যে নীতিকথা তারা আউড়ায়, আর ধরা পড়ে যাওয়া খেলোয়াড়টিকে হেনস্তা করে বিদায় করে তা বুর্জোয়া পরিচালনায় জনপ্রিয় খেলাগুলোর গায়ে এক অনপনেয় কালিমা ছাড়িয়ে দিয়েছে আজকের বিশ্বে, যাথেকে ক্রিকেটও মুক্ত নয়। আন্তর্জাতিক বুর্জোয়ারা আর সব খেলার মত ক্রিকেটকেও সংগঠিত করে জাতীয়তার ভিত্তিতে। তাই, এ ধরনের এক বৈশ্বিক আয়োজনে আন্তর্জাতিক বন্ধুত্বের মহিমার চেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয় বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী রেষারেষি, কোন্দল, সংকীর্ণ জাতিদম্ভ । এই জাতীয়তাবাদ কখনো কখনো এমন জঘন্যতায় পরিণত হয় যে, সমর্থক দর্শকরা মারামারিতে লিপ্ত হয়, তাতে জাতীয়তাবাদী উন্মাদণা বাড়ে, বুর্জোয়া উদ্দেশ্য হাসিল হয় আরো ভালভাবে।

একারণেই খেলার মত নির্মল সার্বজনীন আনন্দময় অনুষ্ঠানের মূল কুশীলব খেলোয়াড়দের রাখা হয় চরমতম নিরাপত্তা বেস্টনীর মাঝে। জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে। তবুও তাদের বিজাতীয় স্বদেশপ্রেমীদের ঢিল খেতে হয়।

বুর্জোয়ারা যতই টিমস্পিরিট, দেশের জন্য খেলা এসবের বানী প্রচার করুক না কেন, এই খেলার একেবারে মর্মমূলে নিহিত রয়েছে তারকা বনার এক ভয়ংকর ও হীন প্রতিযোগিতার মতাদর্শ আর অর্থ বানাবার প্রচেষ্টা। সেজন্যই প্রতিটি দেশে, এবং আমাদের দেশেও খেলোয়াড় নির্বাচন নিয়ে মারাত্মক ধরণের দলাদলি, গ্রুপিং, স্বজনপ্রীতি চলতে থাকে। যার কড়িকাঠে বলি হয় বহু সম্ভাবণাময় খেলোয়াড়ের ভবিষ্যৎ।

খেলোয়াড় আর দর্শক যেখানে খেলার মূল কুশীলব সেখানে বুর্জোয়া ক্রীড়া-ব্যবস্থা খেলোয়াড়কে বানিয়েছে দাস যুগের গ্ল্যাডিয়েটর, আর দর্শকদের বানিয়েছে শুধুই হাততালি দেয়া দর্শক। দর্শকদের-তো প্রশ্নই আসে না, খেলোয়াড়দেরও সত্যিকার কোন অধিকার নেই খেলাকে পরিচালনার, আয়োজনের, টিম সিলেকশনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত দেবার। বুর্জোয়া গণতন্ত্র-যে একটা ফানুস মাত্র, তার সবচেয়ে বড় এক প্রমাণ সম্ভবত পাওয়া যাবে ক্রীড়া ক্ষেত্রে তাদের চরম অগণতান্ত্রিক, ব্যক্তিকর্তৃত্ববাদী, অস্বচ্ছ ও স্বৈরতান্ত্রিক পরিচালনা পদ্ধতিতে।

* বুর্জোয়া পরিচালনার সাধারণ সমস্যাগুলো আমাদের দেশেও হাসিনার সরকার করেছে বৈকী। তারা নিরাপত্তা আর সৌন্দর্যের অজুহাতে হাজার হাজার হকার ও ব্যবসায়ীকে উচ্ছেদ করেছে। তারা এই আয়োজনের সুযোগে দেশপ্রেমের নামে সংকীর্ণ/উগ্র বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের জোয়ার উঠিয়েছে; আর এই ফাঁকে সরকারী ও আওয়ামী রাজনীতিকে চালান করেছে। অন্যদিকে সফলভাবে অন্তত দুই মাসের জন্য দ্রব্যমূল্য, বিদ্যুত, পানি, বেকারত্ব, পুলিশী নির্যাতনসহ জনজীবনের হাজারো সমস্যা থেকে জনগণের দৃষ্টিকে সরিয়ে দিতে পেরেছে। তারা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেশকে তুলে ধরার নামে বিকৃত রাজনৈতিক ইতিহাস (ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে মুজিব কোট পরা একজনকে শেখ মুজিবকে দেখানোর মিথ্যাচারসহ) এবং তিনজন বিখ্যাত সুস্বাস্থ্যবতী গায়িকার অর্থহীন লাফাঙ্গা সঙ্গিতাংশ দেখিয়েছে। তারা স্টেডিয়ামের চারিদিকে বসিয়েছে পেপসি বা এজাতীয় সাম্রাজ্যবাদী প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন। আর মুক্তিযুদ্ধের গলাবাজিওয়ালারা নগর সৌন্দর্যের দায়িত্ব দিয়েছে রাজাকার প্রভাবিত ইসলামী ব্যাংকের কাছে। এসবের পিছনে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের কথা মানুষের মুখে মুখেই ফিরেছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের টিকেটের দাম নিুতম ২ হাজার টাকা থেকে উপরে ১০/২০/৩০ হাজার বা তারো বেশী নির্ধারণ করে প্রথমেই সাধারণ জনগণের সেখানে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আবারো প্রমাণ হয়েছে মুনাফাই আসল, জাতীয় উৎসব আর দেশপ্রেমের কথাবার্তা নিছক বাতকে বাত।

সরকার ও বুর্জোয়া প্রতিনিধিরা জাতির গৌরব আর জাতীয় উৎসবের নামে মুখে ফোয়ারা তুললেও স্পষ্টভাবেই এই বিশ্বকাপে তাদের সকল পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বিদেশকে (তাদের ক্রীড়া-প্রভুদেরকে) দেখানোর প্রয়োজন থেকে, আর দেশে বড় জোর মধ্যবিত্তের একটা সুবিধাভোগী শ্রেণীকে টার্গেট করে।

ক্রীড়ায় অবশ্যই তরুণদের প্রাধাণ্য থাকবে। তাই, শিক্ষাঙ্গনে জায়ান্ট স্ক্রীণ টাঙানোটা ভুল কিছু নয়। কিন্তু শ্রমিকের কৃষকের ঘরে কি তরুণ তরুণী নেই? অন্তত ঢাকার শিল্প এলাকাগুলোতে হাজার খানেক জায়ান্ট স্ক্রীণের ব্যবস্থা করলে সরকার যে ৪০০ কোটি টাকা এতে খরচ করেছে তার খুব একটা বৃদ্ধি ঘটতো বলে মনে হয় না। অন্তত দেশের খেলার দিনগুলোতে গার্মেন্টসগুলো ছুটি ঘোষণা করার পদক্ষেপ কেন বুর্জোয়া সরকার নিতে পারে নি? কারণ, এই শ্রমিক এই কৃষকরা বুর্জোয়াদের ‘জাতি’র মধ্যে পড়ে না। তারা নিজেদের আবেগ-আকাংখাকেই জাতির আবেগ বলে চালায়। এমনকি যে তরুণ ও ছাত্ররা খেলাধুলার প্রধান অংশী, সেই তরুণদের প্রায় ২০ লক্ষ জনের সামনে তখন ছিল এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফুলসেরাত। সে অবস্থায় কীভাবে তারা এই ধরণের জাতীয় উৎসবে সামিল হবে? খেলা-যে বুর্জোয়াদের কাছে খেলা নয়, বরং তাদের টাকা খাটানো ও মুনাফার একটা মাধ্যম মাত্র তা বোঝা যায় আন্তর্জাতিক বুর্জোয়াদের সাথে তাল মিলিয়ে দেশীয় বুর্জোয়া শাসকদেরও যান্ত্রিকভাবে পরীক্ষা বা খেলার সময়সূচীকে অপরিবর্তনীয়ভাবে রেখে দেবার মধ্য দিয়ে।

এ ধরণের অবস্থায় স্পষ্টই এটা বোঝা যায় যে, বাংলাদেশের মত নীচের দিকে পড়ে থাকা পারফর্মেন্সের একটি দেশ কীভাবে কতটুকু এগোতে পারে। ব্যাপক জনগোষ্ঠী থেকে খেলোয়াড় বের করার কোন সুসংবদ্ধ পদ্ধতি দেশে নেই। খেলার মাঠ ঢাকা শহরে নেই বললেই চলে। অন্যত্রও প্রায় একই অবস্থা। মফস্বলের-গ্রামের স্কুল-কলেজগুলোতে এমনকি পাকিস্তান আমলের মত খেলাধুলার চর্চাও নেই। আর শাসকরা চেঁচিয়ে শোনাচ্ছে জাতির বিরাট অগ্রগতির কাহিনী। কিন্তু যখন প্রচার অনুযায়ী দক্ষতা খেলোয়াড়রা দেখাতে ব্যর্থ হন তখন হয় তাদেরকে বলা হয় দেশপ্রেমহীন, অথবা কোচদেরকে করা হয় বলির পাঁঠা। প্রায় সব খেলোয়াড় মাঠে নামেন এক অজানা আশংকায় যে এই বুঝি তার খেলোয়াড়ী জীবনের ইতি হলো। বাস্তবেও খারাপ খেলার অজুহাতে বহু সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ার উপরে বসে থাকা বুর্জোয়া নেতা, যারা দেশের নেতাও বটে, শেষ করে দিতে পারে, দিয়েও থাকে।

সুতরাং খেলাকে খেলা হিসেবেই পরিচালনা ও সংগঠিত করা এবং তার মধ্য দিয়ে ব্যাপক জনগণের জীবনেও খেলার আনন্দ, সৌন্দর্য ও উপকারীতা পৌঁছে দেয়া, বিশেষত তরুণদেরকে শারীরিক ও মানসিকভাবে দৃঢ়, কষ্টসহিষ্ণু হিসেবে গড়ে তোলা, নেতৃত্বের যোগ্যতায় বলিয়ান করা, প্রতিকুলতা পাড়ি দেবার মত সাহসী করে তোলা, জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা অপরিমেয় মেধাকে টেনে তোলা ও বিকাশ করা, সর্বোপরি খেলার পরিচালনা ও সংগঠিত করাকে গুটিকয় বিশেষজ্ঞ বা বুর্জোয়ার পকেটে না রেখে তাকে ব্যাপক জনগণের বিষয় করে তোলা এবং বিশ্বজুড়ে জনগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববন্ধনকে জোরদার করার মাধ্যম হিসেবে খেলাকে নেয়া এসব কোনকিছুই বুর্জোয়া আন্তর্জাতিক ও দেশীয় কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।

এর জন্য প্রয়োজন সম্পূর্ণ নতুন ধরণের সমাজ সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী সমাজ। প্রথমে দেশে, পরে বিশ্বব্যাপী। যখন পুঁজির স্বার্থে খেলোয়াড়রা গ্ল্যাডিয়েটরের ভূমিকায় নামতে বাধ্য হবেন না। যেখানে শুধু কর্মকর্তা নয়, পুঁজিবাদী বিজ্ঞাপনদাতারা নয়, সারা দেশের খেলোয়াড়, দর্শক, সমালোচক সবাই ক্রীড়া কর্মযজ্ঞে অংশ নেবেন। বুর্জোয়ারা যতই বলুক দর্শকই খেলার প্রধান উপাদান, কিন্তু সেটা শুধু মুনাফার খেলাটিকে জমিয়ে তোলার জন্য। নতুবা দর্শকের কোন ভূমিকাই নেই এইসব খেলায়। যত দেশে পুঁজির বিকাশ হচ্ছে, যত দেশে বিদেশী পুঁজির অনুপ্রবেশ বাড়ছে তত খেলা থেকে ব্যাপক জনগণ দূরে চলে যাচ্ছেন, তত তাদের যাও-বা ভূমিকা তা শুধু হয়ে পড়ছে দর্শকের। যোগ্যতা, দক্ষতা, টেকনিক চলে গেছে জনগণের আওতার বাইরে কল্পনার জগতের কিছু অতিমানব বিশেষজ্ঞ খেলোয়াড়ের দখলে।

শুধু নতুন একটি সমাজই একে আমূল বদলে দিতে পারে। আর সব বিষয়ের মত খেলাধুলার ফ্রন্টেও জনগণ, বিশেষত ব্যাপক শ্রমিক-কৃষকের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে খেলাকে সত্যিকারে জাতীয় জাগরণের, জাতীয় পুনর্নির্মাণের একটা ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। জাতিগত বা যেভাবেই সংগঠিত হোক না কেন খেলার জয় পরাজয় যখন কোন নৈতিক পরাজয়, জাতিগত অবমাননা, হীনমণ্যতা বা বিদ্বেষের জন্ম দেবে না। সেদিনের জন্যই শ্রমিক-কৃষক-জনগণকে সংগঠিত হতে হবে। খেলাকে সাধারণ জনগণের সম্পদে পরিণত করতে হবে।

About andolonpotrika

আন্দোলন বুলেটিনটি হলো বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন ও বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের একটি অনিয়মিত মুখপত্র
This entry was posted in আন্দোলন ৮. Bookmark the permalink.

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s