কাশ্মীরিদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করুন

তথাকথিত বুর্জোয়া গণতন্ত্রীরা যে ভারতকে গণতন্ত্রের মডেল হিসেবে আদর্শ মনে করে, এবং স্বাধীনতার বন্ধু মনে করে, সাম্প্রতিক সময়ে সেই ভারতীয় শাসক গোষ্ঠীর কাশ্মীরি জনগোষ্ঠীর উপর নির্বিচার হত্যা, সন্ত্রাস, নির্যাতনের চিত্র ভারতীয় গণতন্ত্রের মুখোশকে আরও একবার বিশ্ববাসীর কাছে নগ্নভাবে উন্মোচন করে দিয়েছে। ভারত আজ কাশ্মীরসহ বিভিন্ন জাতিসত্ত্বাসমূহের কাছে পরিণত হয়েছে এক কারাগারে। ব¯ত্ততঃ ভূ-স্বর্গ কাশ্মীর কাশ্মীরিদের কাছে আজ এক নরক।  কাশ্মীরিদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস অতি দীর্ঘ। ‘৪৭-পূর্ব ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনামলে পরোক্ষভাবে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত স্বাধীন রাজ্যগুলোর মধ্যে কাশ্মীর ছিল অন্যতম। এসব জনগোষ্ঠীর উপর ব্রিটিশদের মাত্রাতিরিক্ত কর ভারের বোঝা যেমন চেপে বসেছিল, একই সাথে রাজ্যগুলোর রাজাদের নানারকম স্বেচ্ছাচারীতা, গণবিরোধী কালাকানুন, ভোগবিলাসের ব্যয় ভার বহন করার ফলে এসব রাজ্যে জনগণ ব্রিটিশ ও রাজাদের বিরুদ্ধে মাঝে মাঝেই বিক্ষোভে ফেটে পড়তেন। ‘৪৭-এ সাম্প্রদায়িকতার বিষ-বাষ্প ছড়িয়ে ব্রিটিশ ও উপমহাদেশে তার দালাল মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া শাসক গোষ্ঠী ভারত পাকিস্তান নামে দুটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের জন্ম দিল। কালক্রমে এসব স্বাধীন রাজ্যগুলোর জনগণের কোন রকম মতামতের তোয়াক্কা না ক’রে  জোর খাটিয়ে বা এক প্রকার বাধ্য করেই এ রাজ্যগুলোকে ভারত-পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত করে এবং তাদের অঙ্গরাজ্য বা প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা দেয়। কাশ্মীর তার মধ্যে অন্যতম। কাশ্মীরের অধিকাংশ এলাকা ভারত দখল করে নেয়। কিছু অংশ পাকিস্তান দখলে নেয়। ভারত ও পাকিস্তান স্ব-স্ব নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরিদের উপর জাতিগত নিপীড়ন-নির্যাতনের পাশাপাশি প্রত্যেকেই নিজ আধিপত্য কায়েমে দ্বন্দ্ব-সংঘাত-চক্রান্তে লিপ্ত থাকে। ফলে কাশ্মীরের জনগণ এই দুই দেশের বিশেষতঃ ভারতের শাসক গোষ্ঠির প্রত্যক্ষ দমন-নির্যাতনে ক্ষুব্ধ। ‘৪৭-পরবর্তী দীর্ঘ ছয়-দশকে এসব জাতিসত্ত্বাসমূহের আন্দোলন-সংগ্রাম নানা উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। ভারতীয় শাসক শ্রেণী ও সরকার দ্বারা নির্যাতিত হয়ে কাশ্মীর আজ আবারো উত্তাল হয়ে উঠেছে। গত ১১ জুন কিশোর বয়সী স্কুল ও কলেজ ছাত্রদের একটি প্রতিবাদ মিছিলে সামরিক বাহিনীর গুলিতে ১৭ বছরের তরুণ নিহত হওয়ায় কাশ্মীরি জনগণ আবারো বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। কোন রাজনৈতিক শক্তি বা সশস্ত্র গোষ্ঠীর দ্বারা সংগঠিত না হওয়া সত্বেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যাপক ছাত্র-যুবক-তরুণ ও বিপুল সংখ্যক নারী এবং ব্যাপক জনগণের উপস্থিতি অতীতের সংগ্রাম থেকে এবারের আন্দোলনকে এক ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। কাশ্মীরিরা আওয়াজ তুলেছেন ‘আজাদী’ বা ‘স্বাধীনতা’র। গত ৫-মাসে রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক শতাধিক মানুষের হত্যা ও শ’য়ে শ’য়ে মানুষের গ্রেফতার-নির্যাতনও এ আন্দোলনকে দমাতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে নানা দেন-দরবার বা খুনি চিদাম্বরাম-এর নেতৃত্বাধীন সর্বদলীয় প্রতিনিধিদের তড়িঘড়ি কাশ্মীরে পৌছানো এবং জনরোষের ভয়ে দ্রুত লেজগুটিয়ে পলায়ন মনমোহন সরকারকে কাশ্মীর প্রশ্নে কোন দিশা দিতে পারেনি। ফলে সেই পুরানো কায়দায় দমন, অর্থ্যাৎ সামরিক বাহিনীর শ্বেত সন্ত্রাস কাশ্মীরে এখনও বলবৎ আছে। অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামনে নিরস্ত্র কাশ্মীরি তরুণদের ইট-পাটকেল ছোঁড়ার দৃশ্য এখন দক্ষিণ এশিয়ায় মধ্যপাচ্যের ফিলিস্তিনীদের ইনতিফাদার কথা মনে করিয়ে দেয়।  প্রতিবারের ন্যায় এবারও ভারতীয় শাসক-গোষ্ঠী কাশ্মীরিদের জাতীয় মুক্তির সংগ্রামকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। এ লড়াইকে বহিঃরাষ্ট্রের ইন্ধন, মুসলিম সন্ত্রাসবাদীদের সম্পৃক্ততা বা মাওবাদীদের যোগসাজশের কথা বলে ভারত রাষ্ট্র তার বর্বর/ফ্যাসিস্ট চরিত্র আড়াল করতে চায়। পাশাপাশি উগ্র জাতীয়তাবাদের ধুয়ো তুলে ভারতের অখন্ডতা বা সার্বভৌমত্বের জিগির তুলে ভারতীয় জনমতকে শাসক শ্রেণীর পক্ষে নিয়ে কাশ্মীরিদের উপর হত্যা-সন্ত্রাসের বৈধতা আদায়ের চেষ্টায় লিপ্ত। যা তারা উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্রেও করে থাকে।  অন্যদিকে সারাবিশ্বে গনতন্ত্র বা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবীদার সাম্রাজ্যবাদের পালের গোদা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কাশ্মীর প্রশ্নে নিরব। কাশ্মীরের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনা করলে ভূ-স্বর্গের এ উত্তপ্ত পরিস্থিতি মার্কিনদের জন্য এক মঙ্গল বার্তা নিয়ে আসে। ভারতের ব্যর্থতাকে কাজে লাগিয়ে কাশ্মীরকে সন্ত্রাস কবলিত এলাকা এবং কাশ্মীরিদের এ আন্দোলন বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকির প্রচার দিয়ে ভারত-মার্কিন যৌথ সামরিক শক্তি সমাবেশ ঘটানোর সুযোগ সৃষ্টি করবে। এর ফলে কাশ্মীরিদের জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম যেমন দমন করা যাবে, একই সাথে উদীয়মান পুঁজিবাদী চীনকেও কোনঠাসা করতে সক্ষম হবে। অপরদিকে ভারতও তার অভ্যন্তরীন নিরাপত্তার জন্য প্রধান হুমকি মাওবাদীদেরকেও দমাতে মার্কিনের পরামর্শ, অস্ত্রের চালান পাবে। দক্ষিণ এশিয়ায় এই দুই শক্তির যৌথ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কার্যক্রমকে এগিয়ে নেবে।  সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া কেন্দ্রীক ভারত-মার্কিনের আধিপত্য বা মোড়লগিরি জোরদারের এ অপচেষ্টাকে নস্যাৎ করতে হলে প্রতিটি গনতন্ত্রকামী দল, সংগঠন, শক্তি ও ব্যক্তিকে কাশ্মীরি জনগণের এ ন্যায্য মুক্তি-আন্দোলনের সাথে সংহতি জ্ঞাপনের পাশাপাশি তাদের (কাশ্মীরিদের) আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার বা বিচ্ছিন্নতার অধিকারের স্বীকৃতির জন্য জোরালো  দাবী রাখতে হবে। একইসাথে একবিংশ শতাব্দীতে দেশে দেশে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সীমাবদ্ধতাকে চিহিৃত করতে হবে। কাশ্মীরসহ সমস্ত জাতীয় মুক্তির আন্দোলন যতক্ষণ পর্যন্ত না সর্বহারা শ্রেণীর মতবাদ ও তার নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠির বা জনগণের প্রকৃত মুক্তি আসতে পারে না। এজন্য প্রয়োজন মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদে সজ্জিত একটি বিপ্লবী পার্টির নেতৃত্ব। এমন একটি পার্টির নেতৃত্বেই ভারত-মার্কিনসহ কাশ্মীরি জনগণের তাবৎ শত্রুদের চিহিৃত ও তাদের বিরুদ্ধে সামগ্রিক সংগ্রাম পরিচালনা করা সম্ভব। কাশ্মীরি জনগণের উপর ভারতীয় সামরিক বাহিনীর দ্বারা পরিচালিত স্বেত-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত মাওবাদী গণযুদ্ধই এনে দিতে পারে কাশ্মীরিদের প্রকৃত স্বাধীনতা ও গনতন্ত্র। ভারতের শক্তিশালী মাওবাদী আন্দোলন শুরু থেকেই কাশ্মীরি জাতি ও জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারকে সমর্থন করছে। এবারও তারা কাশ্মীরি জনতার পাশে দাঁড়িয়েছে। শুধুমাত্র এই নেতৃত্বই কাশ্মীরের সমস্যার সমাধান করতে পারে।

About andolonpotrika

আন্দোলন বুলেটিনটি হলো বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন ও বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের একটি অনিয়মিত মুখপত্র
This entry was posted in আন্দোলন ৭. Bookmark the permalink.

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s