হঠাৎ করেই শেখ হাসিনা ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমের ইউনুসীয় ঘরাণার বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়ে ওঠায় সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন উঠেছে যে, হাসিনা, তার সরকার, তার অর্থমন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রীরা কেন এই জেহাদে এই সময়ে নেমে পড়লো। শুধু যে নেমেছে তা নয়, বরং তাদের প্রধানতম বিশ্ব মুরুব্বী মার্কিন শাসকদের বিরাগভাজন হবার ঝুঁকি পর্যন্ত নিয়ে বসেছে।
কে না জানে যে শুধুমাত্র প্রকৃত বামপন্থীরা বাদে আর বাকী সব প্রধান রাজনৈতিক শক্তি, তাদের বুদ্ধিজীবী ও তাদের সাথে নাচতে অভ্যস্ত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা ইউনুসের নোবেল প্রাপ্তির পর উদ্বাহু নৃত্য করেছিল। তাতে শেখ হাসিনাসহ তার সাঙ্গপাঙ্গরাও শামিল ছিল। তখন তাদের মনে হয়নি যে, ইউনুস সুদখোর, দুর্নীতিবাজ, আইন অমান্যকারী!
কিন্তু ১/১১-এর পর যখন ক্ষমতাদখলকারীরা তৃতীয় শক্তির মুখপাত্র হিসেবে ইউনুসকে সামনে আনতে চেষ্টা করে তখন থেকে শেখ হাসিনা সতর্ক হয়ে যায়। তবে সাম্রাজ্যবাদী-সম্প্রসারণবাদী মদদে শেষ পর্যন্ত হাসিনা-আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসিন করার ফর্মুলা গৃহীত হওয়ায় ক্ষমতার পথের কাঁটা হিসেবে ইউনুসের আর গুরুত্ব থাকেনি। কিন্তু হঠাৎ করে ক্ষমতায় বসার দুই বছর পর আবার ইউনুস সরকারের মাথা ব্যথার কারণ কেন হলো? এটা কি শুধুমাত্র মইন-ফক্কর আমলে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠার প্রচেষ্টার শাস্তিমাত্র?
বিষয়টা এতটা সরল মনে হয় না। কেউ কেউ যে নোবেল প্রাপ্তির প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়া হাসিনার ঈর্ষাকাতর পদক্ষেপ বলে একে ব্যাখ্যা করছেন তা আরো বেশী করে অগ্রহণযোগ্য। শেখ হাসিনা নোবেল পাবার জন্য গত আমলে অনেক দৌড়-ঝাঁপ করেছিল সন্দেহ নেই। আর ইউনুসের সাম্রাজ্যবাদী জনপ্রিয়তায় তার ঈর্ষা হওয়াটা তার গোষ্ঠীগত চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের সাথে যে পুরো মানানসই সেটাও সঠিক। কিন্তু ক্ষমতায় বসে যথেষ্ট প্রতিকুল অবস্থায় এসব নিয়ে প্রভু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এমন একটি বিরক্তির কারণ ঘটানোর মত নির্বোধ আওয়ামীপন্থী শাসকরা নয়। আর এটাও তো সঠিক যে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম হাসিনাসহ সমগ্র শাসক শ্রেণীরই একটা অপরিহার্য কর্মসূচী।
ইউনুস যে আমেরিকার অতি প্রিয় সেটা ইউনুস-কান্ড শুরু হবার প্রথম থেকে আমেরিকার প্রকাশ্য তৎপরতাতেই বোঝা যাচ্ছে। গোপনে যে এর চাইতে বেশী আরো অনেক কিছু চলছে সেটা বলাই বাহুল্য। ইউনুসকে নোবেল পাইয়ে দিতে যারা সবেচেয়ে বেশী ভূমিকা রেখেছিল তাদের মাঝে ছিল খোদ ক্লিনটন ও তার স্ত্রী, যে এখন আমেরিকান বিদেশমন্ত্রী। ইউনুস তাদের স্বার্থে এমন কিছু বড় কাজ করেছে যার জন্য তাদের এই গাঢ় বন্ধুত্ব। সে বিষয়ে আমরা আগে আমাদের পত্রিকায় বিশ্লেষণ করেছি। দেশের সাধারণ জনগণ বোঝেন যে ইউনুসীয় গ্রামীণ ব্যাংক সুদখোরই বটে। কিন্তু এই ব্যবস্থাধীনে জনগণের এই “সুদ দেবার অধিকার” অর্জন ছাড়া উপায়ও নেই। দারিদ্র বিমোচনের নামে বিদ্যমান শ্রেণী শোষণমূলক ব্যবস্থাকে হতদরিদ্র মানুষের বিদ্রোহ বিপ্লব থেকে বাঁচিয়ে রাখবার, একইসাথে নিজেদের মুনাফা করবার দ্বিবিধ এক ব্যাংকিং পদ্ধতির উদ্ভাবণের জন্য গোটা পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বই তার কাছে ঋণী। তাই তার নোবেল প্রাপ্তিটা বুর্জোয়া-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বে কোন ফেলনা বিষয় নয়। শেখ হাসিনা আর ইউনুস কোন বৈরী শ্রেণীস্বার্থের প্রতিনিধি নন, বরং তারা একই বাপের দুই ভাইবোন, বড়জোর সৎ ভাই-বোন। তাই হাসিনা-আওয়ামী লীগের কোন কারণ নেই এই ইউনুসীয় অবদানের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার। শুধুমাত্র ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ইউনুসের দাঁড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা হলেই সেটা হতে পারে। তেমন কোন ঘটনার সম্ভাবনাই এই জেহাদের মধ্য দিয়ে প্রকাশ হচ্ছে।
হাসিনা সরকারের দুই বছর পুরো হবার পর থেকে অনেকগুলো ঘটনা দেখা যাচ্ছে যা শাসকশ্রেণীর মধ্যেকার নতুন করে দ্বন্দ্ব তীব্র হবার আলামত। বিএনপি প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সর্বদাই আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করবে সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু তারা হঠাৎ করে গা ঝাড়া দিয়ে মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা বলছে। সংবিধান নিয়ে সংসদীয় কমিটি, আইন মন্ত্রণালয়, বিচার বিভাগ যা ইচ্ছা তাই করে কার্যত সংবিধান হীন করে ফেলেছে তাদের রাষ্ট্রকে। আওয়ামী জোটভুক্তরা বিশেষত এরশাদ প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনা করছে। সে বলছে যে, মহাজোট ব্যর্থ হলে মহাবিপর্যয় ঘটবে। এর অর্থ কী? তার ভাই জোট-মন্ত্রী জিএম কাদের বলেছে এরশাদের কারণেই ১/১১-এর মাধ্যমে মহাজোট ক্ষমতায় এসেছে। আর এরশাদ যখন বলে যে মহাবিপর্যয়, তার অর্থ হলো হাসিনাকে সে অন্য কোন গোপন শক্তির দ্বারা হুমকি দিচ্ছে মাত্র।
এমন এক পরিস্থিতিতে ইউনুস শাসকশ্রেণী বিশেষত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতার ক্ষেত্রে পুনরায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। শাসকশ্রেণী মাইনাস টু-এর ফর্মূলা বাদ দিয়ে দিয়েছে সেটা ভাবলে ভুল হবে, বিশেষত এদের যে শক্তিমান অংশগুলো ১/১১ ঘটিয়েছিল তারা। বাস্তবে ১/১১-এর কুশিলবদের সাথে চক্রান্তমূলক সমঝোতার মাধ্যমেই হাসিনা-আওয়ামী লীগকে তারা ক্ষমতায় বসিয়েছিল। নির্বাচনটা সেভাবেই সংগঠিত করা হয়, যাকিনা জনগণকে প্রবোধ দেবার একটা উপায় মাত্র। এখন সেই নির্বাচনী খেলার পর আরো দুই বছর পার হবার পর স্পষ্টই জনগণের মোহভঙ্গ হয়েছে। বরং দেশ ও জনগণ এক মহা দুর্যোগের মুখে (এরশাদ ঠিকই বলেছে!)। ওদিকে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর আর্থিক মন্দার প্রভাবে যেমন ইউরোপের দেশগুলোতে গণআন্দোলন জাগছে, তেমনি গণআন্দোলনের জোয়ার শুরু হয়েছে আরব দেশগুলোতে, যেগুলো কিনা দশকের পর দশক সাম্রাজ্যবাদী লুন্ঠন আর নিপীড়নের মৃগয়া ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই, দেশের পরিস্থিতি কোন আন্দোলনের দিকে যায় তা নিয়ে শাসকশ্রেণী ও তাদের প্রভুরা ভাবছে বৈকি। বিশেষত যখন কিনা দ্বিদলীয় বুর্জোয়া রাজনীতি পুনরায় আরো বড় করে ব্যর্থ বলে তারা দেখতে পাচ্ছে। তাই, জনগণ যেন তাদের নিজেদের বিকল্পের পথে না যান সেজন্য শাসকরা নিজেরাই বিকল্প নিয়ে নিশ্চয়ই ভাবছে। এবং তার জন্য কিছু ব্যবস্থা করে রাখতে চাচ্ছে। ইউনুস এজন্য তাদের একটি বড় পছন্দ অবশ্যই।
অন্যদিকে বাংলাদেশকে নিয়ে মার্কিন ও ভারতের স্বার্থ ও পরিকল্পনায় ব্যাপক কোন বৈপরীত্য না থাকলেও সেক্ষেত্রে তাদের মাঝে দ্বন্দ্ব রয়েছে। হাসিনা সরকার যেভাবে প্রথমত ভারতীয় রণনীতিকে সেবা করতে চায় সেটা মার্কিনীদের পুরোপুরি পছন্দের নয়। মার্কিন একইসাথে সরাসরি নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লোকও চায়। সেজন্য ইউনুস মার্কিনের স্বার্থের জন্য হাসিনার চেয়ে বেশী উপযোগী। তাই, পুনরায় তৃতীয় শক্তির খোঁজ ও তার পরিকল্পনা মার্কিনের অবশ্যই রয়েছে, সেটা তারা যখনই কার্যকর করুক না কেন। সেক্ষেত্রে বিএনপি তাদের একটি শক্তি বটে, কিন্তু বিএনপি ভারতীয় লবিকে কিছুটা সংগ্রাম করলেও বেশী করে চীন লবিতে ঝুঁকে কাজ করতে চাইবে, যা আবার মার্কিনের পছন্দের নয়।
এ সমস্ত সমীকরণে ইউনুসকে সামনে আনাটা মার্কিনের প্রয়োজন হতে পারে। কারণ, সরাসরি সামরিক স্বৈরতন্ত্রের বদলে একটি ‘জনপ্রিয়’ (যাকে তারাই জনপ্রিয় করেছে) মুখকে সামনে রাখাটা ভাল। বহু বছরের চেষ্টায় তারা ইউনুসের ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে। ইউনুসের রয়েছে গ্রামীণ গ্র“পের মাধ্যমে একটি বিরাট দরিদ্র সংগঠিত জনগোষ্ঠী। এই শক্তিও মার্কিনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং তারা এই ‘সম্মানিত’ ব্যক্তির সম্মান হানিতে ক্ষুব্ধ হবে সেটাই স্বাভাবিক।
আর শেখ হাসিনা সরকার কোন না কোনভাবে ইউনুসকে পুনরায় সম্ভাব্য পথের কাঁটা হিসেবে জানতে বুঝতে পেরেছে বলেই তাকে, তার ভাবমূর্তিকে, তার ক্ষমতা ও শক্তির উৎস গ্রামীণ গ্রুপকে হেয় করতে ও ক্ষমতাচ্যুত করতে নেমেছে।
এ অবস্থায় জনগণকে আরো সতর্ক হতে হবে বাংলাদেশকে নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণবাদী ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত সম্পর্কে। তাদেরকে একদিকে সরকারী ও আওয়ামী প্রতারণার মুখোশ উন্মোচন করতে হবে, অন্যদিকে ইউনুসের মত ‘সম্মানিত’ সাম্রাজ্যবাদী দাবার ঘুঁটিগুলো সম্পর্কে সতর্ক হতে হবে। আর শাসকশ্রেণীর কোন্দল ও সংকটকে কাজে লাগাতে হবে নিজেদের মুক্তির বিপ্লবী সংগ্রামকে বেগবান করার জন্য। ২০ মার্চ, ২০১১।
আন্দোলন বুলেটিন পুনঃপ্রকাশ নং ৮, এই সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল এপ্রিল, ২০১১ -এ