দিনবদলের শ্লোগান আর গণস্বার্থের বহু প্রতিশ্রুতি দিয়ে আওয়ামী মহাজোট ক্ষমতায় এসে সরকার গঠন করেছিল। সেনা-শিখন্ডি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানে গণতন্ত্রের মুখোশধারী মহাজোট সরকারের প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে জনগণ কিছুটা স্বস্থির আশাও করেছিলেন। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই এই সরকার তার হিংস্র দন্ত, নখর বের করে দানবীয় মূর্তি ধারণ করে। সেনা-শিখন্ডি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আশীর্বাদে গঠিত এই সরকার তাদের ছায়ারূপেই সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদ এবং দালাল বুর্জোয়া শাসক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষায় প্রতিবাদী শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত জনগণের উপর নামিয়ে এনেছে ফ্যাসিবাদী দমনের স্টিম রোলার। দেশের তেল-গ্যাস-কয়লা-বন্দর সহ জাতীয় সম্পদ বহুজাতিক কোম্পানীর হাতে তুলে দেয়ার প্রতিবাদে ২০০৯ সালের ২ সেপ্টেম্বর তেল-গ্যাস-বন্দরসহ জাতীয় সম্পদ রক্ষা কমিটির আয়োজিত সমাবেশে মহাজোট সরকারের পুলিশ হামলা করে। কমিটির সদস্যসচিব আন মুহাম্মদকে প্রহার করে তার দুই পা থেতলে দেয়। এই আন্দোলনের অসংখ্য নেতা-কর্মীদেরও আহত করে। গত মে, ’১০-এর নৌযান শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে এ সরকার বর্বরোচিত কায়দায় দমন করে। আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার, মিথ্যা মামলা দেয়া, সনদপত্র বাতিলের হুমিক দেয়া ইত্যাদি উপায়ে দমন-নিপীড়ন চালায়। ধর্মঘটের সমর্থনে রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সমাবেশে হামলা করে নেতা-কর্মীদের আহত ক’রে সভা পন্ড করে দেয়। গার্মেন্টস মালিকদের মধ্যযুগীয় শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে বিগত সরকারগুলোর ন্যায় মহাজোট সরকার ও পুলিশ র্যাব দিয়ে দমন করে। আয়েশী জীবন যাপনরত মালিকদের স্বার্থে এই সরকার টঙ্গি, সাভার, নারায়ণগঞ্জে গুলি চালিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে দিনযাপনকারী অসংখ্য শ্রমিককে হত্যা ও পঙ্গু করেছে। সরকার নির্ধারিত অন্যায্য মজুরী কাঠামো প্রত্যাক্ষাণ ক’রে শ্রমিক বিক্ষোভকে লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট নিক্ষেপ এবং শত শত শ্রমিক গ্রেপ্তার ক’রে দমন করে। হাজার হাজার শ্রমিকের নামে মিথ্যা মামলা ঠুকে তাদের হয়রানী করে। মালিকদের শত নির্যাতনে শ্রমিকগণ যাতে টু শব্দ না করতে পারেন তার জন্য ৩১ অক্টোবর, ’১০ শিল্প পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার উদ্বোধন করেছে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং নিজে। এই শিল্প পুলিশ গঠনের উদ্যোক্তা ছিল সেনানিয়ন্ত্রিত স্বৈরাচারী তত্ত্বাবধায়ক সরকার। মহাজোট সরকার তার বাস্তব রূপ দিল। অথচ শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার হরণকারী অত্যাচারী মালিকদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা সরকার নিচ্ছে না, কারণ, তারাই সরকার। বরং ইপিজেড এলাকায় সব ধরনের ধর্মঘট নিষিদ্ধ ক’রে তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে অধ্যাদেশটি জারি করেছিল শেখ হাসিনার মন্ত্রীসভা সেটি আইনে পরিণত করার জন্য ২০০৯ সালের আগস্টে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি’র নির্দেশে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের অস্বাভাবিক বেতন-ফি বৃদ্ধি করে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং পরিবহন মালিক মিলে সিন্ডিকেট ক’রে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বর্ধিত ভাড়া আদায় করে। রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ এবং সব ধরণের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বন্ধ রাখা হয়েছে। ক্যাম্পাসে কোন বাক স্বাধীনতা নেই। মেয়েদের হলগুলোতে জারী রয়েছে মধ্যযুগীয় আইন। এ ধরনের অনৈতিক অনিয়মের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীগণ আন্দোলনে যেতে বাধ্য হন। চবি প্রশাসন এবং সরকার ছাত্র-ছাত্রীদের ন্যায়সঙ্গত দাবী-দাওয়াকে মেনে না নিয়ে তাদের উপর জঘন্য নির্যাতনের ঘটনা ঘটায়। ছাত্র-ছাত্রীদের উপর লাঠিচার্জ, রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ ক’রে ১৫০-এর বেশী ছাত্রীসহ শত শত ছাত্র-ছাত্রীদের আহত করে, ৩০০’র বেশী শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে। শিক্ষক লাঞ্ছনার মিথ্যা অভিযোগে একজনকে বহিস্কার করে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কৃষকগণ নিজেদের ভিটে-জমি রক্ষার জন্য সেনাবাহিনীর আবাসন প্রকল্পের বিরোধিতা করলে গত ২৩ অক্টোবর এলাকাবাসীর উপর র্যাব-সেনাবাহিনী গুলি বর্ষণ করে। এতে ১৫জন কৃষক গুলিবিদ্ধ হন, অর্ধশত আহত হন, একজন মারা যান, কয়েকজন নিখোঁজ হন। এখন “গণতান্ত্রিক” সরকারের ভয়ে এলাকাবাসী পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘শান্তি চুক্তি’র ১২ বছর পরও সেনা শাসন চলছে। বিগত আওয়ামী শাসনামলে এই চুক্তি হয়েছিল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট প্রায় দুই বছরকাল ক্ষমতায়। কিন্তু পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার কোন আলামত নেই। সেনা বাহিনীর নেতৃত্বে পাহাড়ী ক্ষুদ্র জাতি সত্ত্বার জনগণকে তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, গ্রেপ্তার, জ্বালাও-পোড়াও এই পৈশাচিক নীতির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। হকার উচ্ছেদ ২১ আগস্ট ,’১০ যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ঘোষণা দিয়েছে যানজট নিরসনে হকার উচ্ছেদ করবে। যদিও পরে তা প্রতিবাদের মুখে ঈদ পর্যন্ত স্থগিত করেছে। যানজটের অনেক কারণের মধ্যে প্রধান একটি কারণ প্রাইভেট কারের অতিরিক্ত ব্যবহার। এই কার উচ্ছেদের উদ্যোগ না নিয়ে হকার উচ্ছেদের উদ্যোগ কেন মন্ত্রীমহোদয় নিয়েছেন, তা থেকেই বোঝা যায় এই সরকার কোন শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে। তাই, শীঘ্র্রই ঢাকার হকার এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। ক্রসফায়ারের নামে হত্যা অব্যাহত ঃ আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল ক্রসফায়ারের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যা বন্ধ করবে। প্রধানমন্ত্রী মুখ রক্ষার্থে দেশে বিদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যা বন্ধের কথা বলে বেড়ালেও স্বারাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রীরা বিচার-বহির্ভূত হত্যার পক্ষে সাফাই গাইছে প্রকাশ্যেই। বিগত জোট সরকারের সূচীত ক্রসফায়ারের নামে হত্যা কর্মসূচী মহাজোট সরকার অব্যাহত রেখেছে এবং অবলীলায় চালিয়ে যাচ্ছে। বিপ্লবী, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, মানবাধিকারবাদী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন সংগঠন, শক্তি, ব্যক্তির প্রতিবাদ-সংগ্রাম , এমনকি তাদেরই বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠান হাইকোর্ট আর মানবাধিকার কমিশনের মতামত-নির্দেশ উপেক্ষা করেই। এ পর্যন্ত এ সরকার ক্ষমতাসীন হবার পর তারা গত অক্টোবর পর্যন্ত ২২৯ জনকে এভাবে হত্যা করেছে। এখন গুম হত্যাও চলছে। এছাড়া মহাজোটের দলীয় কেডারদের খুন, টেন্ডারবাজি, জমিদখলসহ বিভিন্ন সেক্টরে দখলবাজি, সরকারী চাকরীতে দলীয়করণ, সাংবাদিক নির্যাতন, মাদক ব্যবসা, অপহরণ, ইভটিজিং-এর নামে যৌন সন্ত্রাস, আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শনসহ এমন কোন অপরাধ নেই যে তারা না করছে। তা করছে সরকারের ছত্রছায়ায়। বহু ক্ষেত্রে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর আস্কারা ও মদদে। পাবনা-নাটোরের ঘটনাও তার প্রমাণ। উপরের দমন-নিপীড়নের চিত্র থেকে দেখা যায় “গণতন্ত্র” “উন্নয়ন”-এর যত গলাবাজীই এই সরকার করুক না কেন তারা আসলে গণশত্রু সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদ এবং দালাল শাসক শ্রেণীর স্বার্থরক্ষক যা বিগত বিএনপি বা সেনাসরকারেরই অনুরূপ। এক্ষেত্রে এ সকল সরকারের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কারণ, তারা শাসক বড় ধনী শ্রেণীরই প্রতিভূ, সাধারণ জনগণের নয়। এজন্য এ সরকার শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত জনগণের উপর দমন-নির্যাতন চলিয়েই কেবল তাদের ক্ষমতাকে রক্ষা করতে পারে। এটাই তাদের শ্রেণী চরিত্র। তবে জনগণও এখন সচেতন। তারা প্রতিবাদ করেন, প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। যদিও তা খন্ড খন্ড এবং স্বতঃস্ফুর্ত । জনগণের সামনে এখন প্রয়োজন বিপ্লবী দিশা ও সম্মিলিত প্রয়াসের। আজ শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত জনগণের প্রয়োজনী হচ্ছে বিপ্লবী দিশায় সজ্জিত বিপ্লবী আন্দোলনে যোগদান করা এবং গণক্ষমতা প্রতিষ্ঠার বিপ্লবী সংগ্রাম গড়ে তোলা, তাকে এগিয়ে নেয়া। কেবলমাত্র এ পথেই সম্ভব এই গণশত্রু শাসক শ্রেণী, রাষ্ট্রযন্ত্র ও সরকারের নিপীড়নকারী ব্যবস্থা থেকে মুক্তি। ৩ নভেম্বর, ’১০
-
সাম্প্রতিক লেখা
সংগ্রহ
বিষয়
-
Join 6 other subscribers
Blogroll
Top Clicks
- None