জন্মলগ্ন থেকেই এ দেশের শাসক শ্রেণী সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদের স্বার্থের দালালী করে আসছে। বিএনপি-জামাত গোষ্ঠীর ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ প্রশ্নে কিছু রাখঢাক রয়েছে, গণ প্রতারণার জন্য এটি তাদের হাতিয়ারও বটে। কিন্তু আওয়ামী লীগ এক্ষেত্রে বরাবরই উলঙ্গ।
এবারও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর পরই ভারতের স্বার্থে কর্মসূচী বাস্তবায়নের তোড়জোড় চলছে। গত বছর জানুয়ারী,’১০-এ প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে গিয়ে যে তিনটি নিরাপত্তা চুক্তি ও ২টি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে এসেছে এবং ভারতেকে বাংলাদেশের ১৪টি পয়েন্টে ট্রানজিট নামের করিডোর দিতে রাজী হয়েছে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অসংখ্য কর্মসূচী নিয়ে ভারতের সাথে জড়িত হয়েছে তাতে ভারত-বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের কোন স্বার্থ নেই।
বিশ্বব্যাপী আজ প্রচারিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্র্টির (মাওবাদী) নেতৃত্বে শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্ত ও আদিবাসী নিপীড়িত জনগণের মুক্তি সংগ্রাম চলছে। সম্প্রতি তা তীব্র আকার ধারণ করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং স্বীকার করেছে মাওবাদীদের নেতৃত্বে এই সংগ্রাম ভারতীয় শাসক শ্রেণীর জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। তাই, তারা অপারেশন গ্রিনহান্ট নাম দিয়ে এই বিপ্লবী সংগ্রামকে দমনে পাগলা কুকুরের মত ঝাঁপিয়ে পড়েছে। অন্যদিকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭টি রাজ্যে জাতিগত নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলন চলছে যা ভারতীয় শাসক গোষ্ঠীর জন্য এক মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে রয়েছে। ভারতের এই সব বিপ্লবী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে নির্মূল করার জন্যই মূলতঃ হাসিনা-মনমোহনের এই নিরাপত্তা চুক্তি। এছাড়া বাংলাদেশেও মাওবাদী আন্দোলন চলছে। “সন্ত্রাস” ও “জঙ্গিবাদ” দমনের নামে ভারত যাতে এই বিপ্লবী সংগ্রাম দমনে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে তার পথও তারা পরিস্কার করে রাখলো।
আওয়ামী-জোট ক্ষমতায় আসার পরপরই শেখ হাসিনা আঞ্চলিক টাস্কফোর্স গঠন করার ঘোষণা দিয়েছিল যা ছিল মূলতঃ ভারতের লাঠিয়ালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার এক বাসনা। এই নিরাপত্তা চুক্তির পূর্বেই নভেম্বর-ডিসেম্বর,’১০-এ আসামের স্বাধীনতাকামী সংগঠন উলফা সভাপতি অরবিন্দ রাজখোয়াসহ তাদের উর্ধ্বতন ১০জন নেতা-কর্মীকে শেখ হাসিনার সরকার গ্রেপ্তার করে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের হাতে তুলে দেয় এবং উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার পাঁয়তারা করে। এটি হাসিনার লাঠিয়ালগিরির এক জ্বলন্ত প্রমাণ। মার্কিনের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী যে “সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ” চলছে, হাসিনা-মনমোহন নিরাপত্তা চুক্তি তারই অংশ। উইকিলিক্সের ফাঁস করা তথ্যেও তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে যে ১৪টি পয়েন্টে ভারতকে ট্রানজিট নামের করিডোর দেয়া হচ্ছে তার বাস্তবায়নের কাজ জোরে-শোরে চলছে। এর জন্য ভারত বাংলাদেশকে ৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। হাসিনা সরকার এই ঋণের টাকায় ১৪টি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। যার মাধ্যমে ভারত ট্রানজিট সুবিধা ভোগ করতে পরিপূর্ণ অবকাঠামো তৈরী অবস্থায় পাবে। এই ঋণের শর্তানুযায়ী প্রকল্পের জন্য ৮৫শতাংশ পণ্য কেনা, পরামর্শক ও সেবা ভারত থেকেই নিতে হবে। বাকী মাত্র ১৫শতাংশ নেয়া হবে বাংলাদেশ থেকে। আর ঋণের ৭হাজার কোটি টাকার জন্য ২০বছরে শুধু সুদ বাবদ বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হবে প্রায় ৩হাজার কোটি টাকা। ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার প্রতিবাদ হলে সরকারের মন্ত্রীরা প্রচার দেয় ভারতকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ আর্থিক লাভে সয়লাব হয়ে যাবে। অথচ ইতিমধ্যেই পত্র-পত্রিকা থেকে জানা যাচ্ছে ভারত বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে বাংলাদেশের উপর দিয়ে চলাচলকারী ভারতীয় কার্গোর জন্য এনবিআর যে শুল্ক নির্ধারণ করেছে তা যেন উঠিযে নেয়। বাংলাদেশ সরকার তা স্থগিতও করেছে। অর্থাৎ, শুল্ক ছাড়াই ভারত ট্রানজিট ব্যবহার করবে।
এটাতো গেল আর্থিক দিক। এই ট্রানজিট ব্যবহারের রাজনৈতিক সামরিক দিকও রয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে শুধু পণ্য পরিবহন নয়, এই অঞ্চলের জাতিগত নিপীড়ন বিরোধী সংগ্রাম দমনে সামরিক সরঞ্জাম ও প্রয়োজনে বাহিনী সরবরাহও তাদের অন্যতম লক্ষ্য। এছাড়া ভারত-মার্কিনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠা নতুন অর্থনৈতিক শক্তি পুঁজিবাদী চীনকে ঘেরাও করার জন্য দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ভারত-মার্কিন সামরিক প্রস্তুতির অংশ এটি। ভারত-মার্কিনের ষড়যন্ত্রের অংশীদার হয়ে বাংলাদেশকে সার্বভৌমত্বের হুমকিতে ফেলা ছাড়া এই ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশের কোন সুবিধাই পাবে না।
এই দালাল সরকার ভারত থেকে বিদ্যুত আমদানী নামে মূলতঃ বিদ্যুৎ উৎপাদনের চাবিকাঠি ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। খুলনায় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ১,১০০ কোটি টাকা ব্যয় করে ১২০ কিলোমিটার গ্রিড লাইন স্থাপন এবং ১৪৩ কিলোমিটার ট্রান্সমিশন লাইন স্থাপন করে ৩ বছর পর ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানীর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২৫ বছরের এই চুক্তিতে রয়েছে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, যুদ্ধকালীন সময়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকলে ভারত তার জন্য দায়ী থাকবে না। অথচ এই ১১০০ কোটি টাকা খরচ করে বাংলাদেশ নিজেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারতো। তা না করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মত অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে এই নতজানু সরকার।
এই সরকার বাংলাদেশের টেলিখাতের বিরাট অংশ ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। ভিওআইপি ব্যবসার সাথে জড়িত হওয়ার অভিযোগে দেশীয় ৫টি টেলিকোম্পানীর লাইসেন্স বাতিল করে দেয় বিটিআরসি। অথচ বিদেশী এয়ারটেল বাংলাদেশের বাজার দখল করে নিয়েছে। ভারতের এয়ারটেল টেলিকোম্পানী বাংলাদেশের সংযুক্ত আরব আমিরাত ভিত্তিক ধাবি গ্রুপের ওয়ারিদ টেলিকমের ৭০ শতাংশ প্রথমে, পরে পুরোটাই কিনে নেয়। ওয়ারিদের প্রকৃত মূল্য সাড়ে তিন থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা। সে হিসেবে ওয়ারিদ থেকে এয়ারটেলের হাত বদলের সময় বাংলাদেশকে দিতে হতো শেয়ার মূল্যের ৫.৫ ভাগ। অর্থাৎ, প্রায় ১২০ কোটি টাকা। কিন্তু এয়ারটেল কোম্পানী ওয়ারিদের মোট মূল্য ১কোটি টাকা দেখিয়ে ৭০ শতাংশের মূল্য ৭০ লক্ষ টাকায় কেনা দেখিয়ে ৫.৫ ভাগ হিসেবে সরকারকে দিয়েছে মাত্র ৩ লক্ষ ৮৫ হাজার টাকা। যুক্ত হিসেবে তারা দেখিয়েছে ওয়ারিদ একটি লোকশানী প্রতিষ্ঠান। এভাবে বিরাট অংকের অর্থ ফাঁকি দিয়ে এবং অবৈধভাবে লাইসেন্স করে ভারতীয় এয়ারটেল কোম্পানী বাংলাদেশের বাজার দখল করেছে। এখন ভারত বাংলাদেশের কাছে টেলিকরিডোরও দাবী করছে। আর দালাল সরকার ভারতকে টেলিকরিডোর দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সবের মধ্য দিয়ে ভারত বাংলাদেশের তথ্য প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা হাতে নিচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রেস-প্রিন্টিং ব্যবসা স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকলেও এই সরকার ভারতকে এক্ষেত্রে ব্যবসা করার সুবিধা দিচ্ছে। গত বছর পাঠ্যপুস্তকের এক বিরাট অংশ ভারত থেকে ছেপে এনেছে। ভারত থেকে কোটি কোটি টাকার বই বিনাশুল্কে আনার পাঁয়তারা করছে।
সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফ অহরহ বাংলাদেশীদের হত্যা করছে। গত ১০ বছরে এক হাজারেরও বেশী নিরপরাধ বাংলাদেশী জনগণকে হত্যা করেছে বিএসএফ। সীমান্তে ঢুকে বাংলাদেশের জমি দখল, ফসল কেটে নেয়া, লুটপাট ইত্যাদি আগ্রাসী তৎপরতা চালালেও এই নতজানু পাচাটা সরকার কোন শক্ত প্রতিবাদ করছে না। গত জানুয়ারী,’১১-এ ১৫ বছরের ফেলানীকে গুলি করে হত্যা করে কাঁটাতারে ৮ ঘন্টা ঝুলিয়ে রাখে এই খুনী বাহিনী। এ পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে দেশের তরুণ প্রজন্মসহ সর্বস্তরের জনগণ প্রতিবাদের ঝড় তুললে নতজানু এ সরকার দীর্ঘ ১২ দিন পরে ক্ষীণ প্রতিবাদ জানায়। এর আগে দুই দেশের সীমান্তে যৌথ-টহলের ভারতীয় প্রস্তাবে সই করে প্রকারান্তরে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশীদের হত্যার দায়ভার কাঁধে তুলে নেয়ার আত্মঘাতী এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ সরকার। বাংলাদেশে বৃহত্তর সিলেটকে মরুকরণের হুমকিতে ফেলে ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে প্রতিবাদ না করে মূলতঃ সায় দিচ্ছে তারা। এভাবে মহাজোট সরকার অসংখ্য উপায়ে ভারতের নগ্ন দালালী করছে। অথচ বাংলাদেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বহু বহু সমস্যায় ভারত কর্ণপাতই করছে না।
নেপাল-ভূটানে চলাচলের জন্য বাংলাদেশকে ভারতের ট্রানজিট দেয়ার কথা বললেও তার কোন সমাধান হয়নি। বেরুবাড়ীর বিনিময়ে তিন বিঘা করিডোর স্থায়ী লিজ দেয়নি, তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি হয়নি এখনও। গঙ্গা চুক্তি থাকলেও বাংলাদেশ ন্যায্য পানির হিস্যা পাচ্ছে না। সমুদ্র সীমা নির্ধারণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা পরিস্কার হচ্ছে, এ সরকার বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্রকে ভারতের হাতে তুলে দিচ্ছে। রাজনৈতিক-সামরিকভাবে মার্কিনের নেতৃত্বে ‘সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ’র অংশ হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-মার্কিনের যুদ্ধ পরিকল্পনায় বাংলাদেশকে জড়িত করছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বিপ্লবী গণতান্ত্রিক আন্দোলন নির্মূল করতে বাংলাদেশ ভারত-মার্কিনের লাঠিয়ালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। আর শাসক শ্রেণীর অপর অংশ বিএনপি জামাত গোষ্ঠী ভারত বিরোধিতার নাম করে মাঠ গরম করলেও মহাজোট সরকারের গণবিরোধী ভারত-প্রীতির বিরুদ্ধে কোন শক্ত কর্মসূচী গ্রহণ করেনি। যা তারা দলীয় স্বার্থে তুচ্ছ ঘটনায় করে থাকে। অন্যদিকে ভূয়া বাম সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, সাম্যবাদী দল সরকারের নতজানু জাতীয় বিশ্বাসঘাতক চুক্তি-সমঝোতা এবং গণবিরোধী কর্মসূচীর সমর্থন দিয়ে শাসক শ্রেণীর লেজুড়, উচ্ছিষ্টভোগী হিসেবে নিজেদের পরিচয় খোলামেলা করছে।
দেশের সকল দেশপ্রেমিক জনগণকে এখনই এই জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতার কর্মসূচীকে প্রতিহত করার জন্য ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত হতে হবে। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এসবকে প্রতিহত করতে হবে। এবং দেশপ্রেমিকের বেশে এই দেশদ্রোহীদের বিচার করতে হবে।