অপারেশন গ্রিনহান্ট’ব্যর্থ করে এগিয়ে চলেছে ভারতের মাওবাদী আন্দোলন

মাওবাদী গণযুদ্ধ দমনে কুখ্যাত অপারেশন “গ্রিনহান্ট” যতই ব্যর্থ হচ্ছে ভারতের শাসক শ্রেণী ততই ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠছে। ২০০৫ সাল থেকে শুরু হওয়া “সালওয়া জুদুম” ব্যর্থ হওয়ার পর ২০০৯ সালের নভেম্বর “গ্রিনহান্ট” নামে দেশব্যাপী নতুন দমন অভিযান শুরু করে ভারতীয় রাষ্ট্র। যার লক্ষ্য বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত নিপীড়িত জনগণের গণক্ষমতাকে ধ্বংস করা, গণযুদ্ধকে উচ্ছেদ করা এবং তার নেতৃত্বদানকারী মাওবাদী পার্টিকে শেষ করে দেয়া। প্রথমে এই দমন অভিযানের সময়সীমা ১বছর নির্ধারণ করা হলেও পরে তা বাড়িয়ে ৫বছর করা হয়েছে।

সাম্রাজ্যবাদ এবং তাদের দালাল ভারতীয় শাসক আমলা-মুৎসুদ্দী শ্রেণীর যোগসাজশে বহুজাতিক নামধারী সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানীগুলোর দ্বারা আদিবাসী অঞ্চলের খনিজ সম্পদ লুটপাটের এক সর্বনাশা কর্মযজ্ঞ চলছে ভারতে। একে প্রতিরোধকারী জনগণকে হত্যা এবং তাদের বাড়ীঘর পুড়িয়ে ভিটেছাড়া করা হচ্ছে “গ্রিনহান্টে”র মাধ্যমে। যেহেতু মাওবাদীরা নিপীড়িত জনগণের পক্ষ নিচ্ছেন, এবং তাদেরকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাই হত্যা করা হচ্ছে মাওবাদী নেতা-কর্মীদের। সর্বশেষ ১১/৩ খুন করা হয়েছে “পুলিশের সন্ত্রাসবিরোধী জনসাধারণের কমিটি”র নেতা ছত্রধর মাহাতোর ভাই লালগড়ের বিখ্যাত মাওবাদী নেতা শশধর মাহাতোকে। যথারীতি যৌথ বাহিনী এনকাউন্টারে নিহত হওয়ার গল্প প্রচার করেছে। কিন্তু শশধরের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে প্যারোলে এসে অংশগ্রহণকারী ছত্রধর মাহাতো বলেছেন এনকাউন্টার নয়, শশধরকে ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে। এই হত্যার প্রতিবাদে সিপিআই(মাওবাদী)’র ডাকে ঝাড়খন্ড-উড়িষ্যা-পশ্চিম বাংলা এই তিন রাজ্যে ১২/১৩/১৪ মার্চ এই তিনদিন বন্ধ/হরতাল পালিত হয়েছে।

ইতিপূর্বে অন্ধ্র প্রদেশের পুলিশ সিপিআই(মাওবাদী)’র কেন্দ্রীয় মুখপাত্র এবং পলিট ব্যুরোর সদস্য ক.আজাদকে নাগপুর থেকে গ্রেফতার করে বিমানে করে তেলেঙ্গানার জঙ্গলে নিয়ে হত্যা করে। এবং তারপর তারা সংঘর্ষে মৃত্যুর খবর প্রচার দিয়েছিল। পার্টি সম্পাদক ক.গণপতি সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আজাদকে হত্যা করা হলেও তার চিন্তা-চেতনাকে শাসক শ্রেণী হত্যা করতে পারবে না, বিপ্লবকে ধ্বংস করা যাবে না।

মাওবাদী গণযুদ্ধ ও আদিবাসী উচ্ছেদের এই ঘৃণ্য পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ভারতের প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবীদের বিরাট অংশ প্রতিরোধ আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। ফলে শাসক শ্রেণী বুদ্ধিজীবীদের উপর আরও হিংস্র ফ্যাসিবাদী কায়দায় নিপীড়ন ও আক্রমণ শুরু করেছে।

গণযুদ্ধের সমর্থক অন্ধ্রপ্রদেশের বিখ্যাত কবি ভারভারা রাও এবং গণসঙ্গীত শিল্পী গদ্দরকে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের পর আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন লেখিকা অরুন্ধতী রায়ের বিরুদ্ধে ছত্তিশগড় ও দিল্লীতে হয়রানীমূলক মামলা দায়ের করেছে। মানবাধিকার বিষয়ে জাতিসংঘের স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত মানবাধিকার কর্মী ডা.বিনায়ক সেনকে মাওবাদীদের সহযোগিতার অভিযোগ ছত্তিশগড়ের জজকোর্ট যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করেছে। এই রায়ের বিরুদ্ধে মানবাধিকার কর্মীরা আপিল করেছেন। সমগ্র ভারতে এবং তার বাইরে বিনায়ক সেনের মুক্তির দাবীতে জোরদার প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠেছে।

৭/২/১১ পৃথিবীর ৪০জন নোবেল বিজয়ী এক যুক্ত বিবৃতিতে নিঃশর্তভাবে বিনায়ক সেনের মুক্তি দাবী করেছেন। এ ছাড়া আমেরিকা-কানাডা-যুক্তরাজ্যের ৫৫টির মতো সংগঠনের জোট “ফ্রি বিনায়ক সেন কোয়ালিশন” নামে একটি সংগঠন বিশ্বব্যাপী ব্যাপক তৎপরতা পরিচালনা করছে। বিভিন্ন দেশে ভারতীয় দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ মিছিলসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচী পালন করছে। ভারতের নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনও বিনায়ক সেনের মুক্তির সপক্ষে অনেক নিবন্ধ লিখেছেন। এছাড়া সারা ভারতে মুক্তির দাবীতে ব্যাপক প্রচার অভিযান চলছে।

অন্যদিকে সিপিআই(মাওবাদী)’র নেতৃত্বাধীন “পিপলস লিবারেশন গেরিলা আর্মি(পিএলজিএ)” পাল্টা সামরিক এ্যকশনের মাধ্যমে “গ্রিন হান্ট”-কে ব্যর্থ করে দিচ্ছে। সরকারী বাহিনী অনেক সময় গ্রামবাসীদের হত্যা করে গেরিলা স্কোয়াড ধ্বংসের মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে। ১৪ফেব্র“য়ারী/১১ উড়িষ্যার মালকানগিরি জেলার কালেকটর (ডিসি) আরবি কৃষ্ণকে এক ইনজিয়িারসহ মাওবাদী গেরিলারা গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। পরে ১৫জন আদিবাসী বন্দীর মুক্তি ও কয়েকটি মামলা প্রত্যাহারের বিনিময়ে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তির পর ডিসি মিডিয়ার সাথে এক সাক্ষাৎকারে গেরিলাদের আচার ব্যবহারের ভূয়শী প্রশংসা করেছে।

১/৩/১১ ঝাড়খন্ডের ছাতরা জেলায় এক আকস্মিক আক্রমণের মাধ্যমে ২৩জন পুলিশকে খতম করে অস্ত্র দখল করে নিয়েছে মাওবাদীরা। ২/৩/১১ বিহারে ৩টি সরকারী অফিস গেরিলারা মাইন দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে। ১৪/৩/১১ ছত্তিশগড়ের দান্তেওয়াড়া জেলায় পুলিশী টহল দলের উপর আক্রমণ করে ৩জন পুলিশকে হত্যা করেছে।

অপারেশন “গ্রিনহান্ট” জঙ্গলের মাওবাদী গণযুদ্ধকে কীভাবে ভারতের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে তা বোঝা যায় ২১ জানুয়ারী পশ্চিম বাংলার রাজ্যপাল এমকে নারায়নের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এক সেমিনারের বক্তব্য থেকে। কুখ্যাত কমিউনিস্ট বিরোধী এই রাজ্যপাল বলেছেন আজকাল মাওবাদ বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ব বিদ্যালয়ের সুশীল সমাজের এক অংশের কাছে ফ্যাশন হয়ে উঠছে।

এভাবে অপারেশন “গ্রিনহান্ট”-এর দমনাভিযানকে প্রতিরোধ করে ভারতে গণুযুদ্ধ দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে।

১৬/৩/১১

About andolonpotrika

আন্দোলন বুলেটিনটি হলো বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন ও বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের একটি অনিয়মিত মুখপত্র
This entry was posted in আন্দোলন ৮. Bookmark the permalink.

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s