(‘আন্দোলন’-এর একজন পাঠক নিচের লেখাটি আমাদেরকে পাঠিয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ বিধায় লেখাটি আমরা ছেপে দিচ্ছি- স.বো.)
ভূমিকা :
“পার্টি নাই, পার্টি ছিল না”-লাইনের প্রবক্তা এম.আর.চৌধুরীর ভক্ত জনাব আবির হাসান এ বছর ফেব্রুয়ারিতে একটি পুস্তিকা লিখেছেন। শিরোনাম দিয়েছেন “হায় কমিউনিস্ট পার্টি, হায় বিপ্লব”। প্রকাশ করেছে ডাকঘর প্রকাশন; লালবাগ, রংপুর থেকে। হাতে লিখে প্রচ্ছদ করেছেন নাহিদ নলেজ, “গায়ের দামে বিক্রি পনের টাকা”। খুবই ছোট ছোট অক্ষরে নিউজপ্রিন্টে ছাপানো।
এ পুস্তিকায় লেখক এদেশের সকল প্রকাশ্য/গোপন বামপন্থী দলের মূল্যায়ন করেছেন এবং একটি কমিউনিস্ট পার্টি কেমন হওয়া উচিত তার লাইন তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এটা করতে গিয়ে তিনি মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন এবং ক্বচিৎ মাওয়ের বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত উদ্ধৃতি দিয়েছেন এবং ঢালাও আক্রমণ করেছেন কমিউনিস্ট নামের সকল পার্টিকে। এদেশের কমিউনিস্ট পার্টির ধারাবাহিক ইতিহাস কি, আন্তর্জাাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাধারণ লাইনের বিকাশের ইতিহাস কি এবং এখন কোন মানদন্ডে কমিউনিস্ট পার্টি বানানো উচিত তা এখানে অনুপস্থিত। চিহ্নিত করেননি ভুল, ত্রুটি, সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কোনগুলো কমিউনিস্ট পার্টির বা কমিউনিস্টদের ভুল, আর কোনগুলো সংশোধনবাদ। ফলে সংশোধনবাদীদের লাইনের সমকাতারে ফেলে কমিউনিস্ট পার্টি ও বিপ্লবীদের ভুল/ত্রুটিকে এবং অনেক ক্ষেত্রে সঠিকতাকেও এনেছেন অন্যায়ভাবে। যা বিপ্লবী অনুশীলনবিহীন, কিন্তু বিপ্লব আকাংখী মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের ও দোদুল্যমান বিপ্লবীদের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি ও বিপ্লব সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তাদেরকে বিভ্রান্ত করতে শর্ত দেবে। সেজন্য এ পুস্তিকাটির সমালোচনা হওয়া প্রয়োজন। এত বেশী বিষয়ে লেখক খুচরো খুচরো মত উত্থাপন করেছেন যে এখানে সেগুলোর সামগ্রিক উত্তর দেয়া অসম্ভব ও অনাবশ্যক। তাই, এখানে আমরা পুস্তিকার মূল কিছু পয়েন্টকে ধরে আলোচনা করছি। এজন্য প্রথমেই এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে লাইনগত সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরছি যাতে পাঠকের বিচার করতে সুবিধা হয় প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টির প্রাথমিক মানদন্ডটা কি হওয়া উচিত।
এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস :
বৃটিশ পর্বে ১৯২০ সালে রাশিয়ার তাসখন্দে এবং ১৯২৫ সালের পর থেকে দেশের ভেতরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের মধ্য দিয়ে অবিভক্ত ভারতেবর্ষে কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা কাজ শুরু করেন। বিশ্ব বিপ্লবের অংশ হিসেবে অবিভক্ত ভারতে তারা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রচার, একে শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবের বিজ্ঞান হিসেবে জনপ্রিয় করা ও প্রতিষ্ঠিত করা, ব্যাপক শ্রমিক-কৃষকের কাছে নিয়ে যাওয়া ও এই আদর্শের জন্য আত্মপ্রতিষ্ঠার সকল মোহ ত্যাগ করে জেল, জুলুম, অনাহার, দারিদ্র মেনে নেয়া, সর্বোপরি বীরত্বের সাথে জীবন উৎসর্গ করে কমিউনিস্ট, কমিউনিস্ট পার্টি ও সমাজতন্ত্র-কমিউনিজমকে তুলে ধরেছিলেন। এই পার্টি তেভাগা, তেলেঙ্গানার মতো বড় আকারের কৃষক-ভিত্তিক বিপ্লবী ও গণসংগ্রামসহ আরো অনেক আন্দোলন জাগরিত করেছিল। যদিও তা সাম্রাজ্যবাদ এবং পরে তার দালাল শাসক বুর্জোয়া ও সামন্তশ্রেণীকে উচ্ছেদ করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের অবস্থান থেকে পার্টি গড়ে তোলা ও সংগঠন-সংগ্রামকে পরিচালিত করতে পারেনি। এবং অর্থনীতিবাদ-সংস্কারবাদে আটকা পড়েছিল। তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কমরেড স্ট্যালিনের নেতৃত্বে ৩য় আন্তর্জাতিকের ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামের লাইন ভারতে যান্ত্রিকভাবে অনুসরণের ভুল করেছিল। কিন্তু এসব ভুল ত্রুটি সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও সেই সময়ে ভারতে সেটাই ছিল কমিউনিস্ট পার্টি। সে পার্টির অর্জন কমিউনিস্টদেরই অর্জন। সে পার্টির ভুল, বিচ্যুতি, সীমাবদ্ধতা একটি কমিউনিস্ট পার্টিরই ব্যর্থতা। অর্থাৎ সে সময়কার সঠিকতা/বেঠিকতাকে ৩য় আন্তর্জাতিকের লাইন, মানদন্ড ও পরিচালনা এবং সদস্য পার্টি হিসেবে নিজ দেশের বাস্তবতায় সে অনুযায়ী সৃজনশীল লাইন গড়ে তোলা ও প্রয়োগের সাথে সম্পর্কিতভাবেই বিচার করতে হবে; বিচ্ছিন্ন ভাবে নয়।
কমরেড স্ট্যালিন কর্তৃক ৩য় আন্তর্জাতিক ভেঙ্গে দেয়া এবং তাঁর মৃত্যুর পর সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টিতে ক্রুশ্চভীয় সংশোধনবাদের উদ্ভব, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার প্রভাব এবং কমরেড মাওসেতুঙ-এর নেতৃত্বে এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহাবিতর্ক পরিচালনার মধ্য দিয়ে বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন নতুনভাবে বিন্যস্ত হতে শুরু করে। এবং চীনের মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তা মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে কমিউনিস্ট মতবাদের তৃতীয় স্তর মাওচিন্তাধারায় উন্নীত করে। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন নতুনভাবে পুনর্গঠিত হতে থাকে। যা পার্টি গঠন, কর্মসূচি, বিপ্লবের স্তর, ক্ষমতাদখলের পথ, আন্তর্জাতিক সাধারণ লাইন প্রশ্নে বিকশিত নতুন কমিউনিস্ট মানদন্ডকে তুলে ধরে। যে সকল পার্টি, সংগঠন, নেতৃত্ব সে সময় মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওচিন্তাধারা অনুযায়ী পার্টি গঠনের লাইন গ্রহণ করতে পারেনি, তারা শেষ পর্যন্ত বিপ্লব বর্জন করেছে। তারা বার্নেস্টাইন, কাউটস্কিদের ধারাবাহিকায় ক্রুশ্চভপন্থী, সংশোধনবাদী পার্টি গঠন করে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদের লেজুড়বৃত্তিতে গড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ, পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকে সত্তর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ মানদন্ডের ভিত্তিতেই কমিউনিস্ট পার্টি, সমাজতন্ত্র, কমিউনিজম ও বিপ্লবকে দেখতে হবে।
এ সময় আন্তর্জাতিক মহাবিতর্ক ও চীনা পার্টিতে মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রভাবে এবং তাকে ভিত্তি করে ভারতে কমরেড চারু মজুমদারের নেতৃত্বে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি(এম.এল) গড়ে ওঠে। এটা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন ধরনের কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে অনুপ্রেরণা যোগায়। আমাদের দেশে সিরাজ সিকদার, সুখেন্দু দস্তিদার, আবদুল হক, তোয়াহা, আবদুল মতিন প্রমুখ নেতৃত্ব পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি(ইপিসিপি-এম.এল), পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি(এম.এল), সাম্যবাদী দল(মা-লে) গঠন করে তৎকালে কমিউনিস্ট শিবিরের প্রতিনিধিত্ব করেন। যদিও এদের অধিকাংশই পরে সংশোধনবাদে অধঃপতিত হন। তবে আগের সময়ে তাদের ও তাদের কেন্দ্রগুলোর ভুল-ত্রুটি, বিচ্যুতি, সীমাবদ্ধতা কমিউনিস্ট শিবিরের মধ্যকার সমস্যাই ছিল।
‘৭৬-সালে মাওয়ের মৃত্যুর পর চীনে হুয়া কুয়ো ফেঙ ও তেঙ শিয়াও পিং চক্র সামরিক ক্যুদেতার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রতিনিধিত্বকারী নতুন নেতৃত্ব কমরেড চ্যাং চুন চিয়াও ও কমরেড চিয়াং চিংসহ চারজন নেতৃত্বকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মাওবিরোধী চার কুচক্রী হিসেবে অভিযুক্ত করে বন্দী করে এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে সংস্কারের নামে পুঁজিবাদের পথ অনুসরণ করতে থাকে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টিতে এই নয়া সংশোধনবাদের পাশাপাশি আলবেনিয়ার এনভার হোঙ্াও গোড়ামীবাদী সংশোধনবাদী অবস্থান থেকে মাওসেতুঙ চিন্তাধারা ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের বিরুদ্ধে উন্মত্ত আক্রমণ হানতে থাকে। যা ছিল লাল পতাকা দিয়ে লাল পতাকাকেই আক্রমণের লাইন। এ সময়ে আমাদের দেশে কমরেড আনোয়ার কবীরের নেতৃত্বে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি এবং কমরেড মোফাখ্খার চৌধুরীর নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি(এম.এল) তেং ও হোক্সাপন্থী সংশোধনবাদীদের আক্রমণ থেকে মাওবাদকে রক্ষা ও প্রয়োগে নেতৃত্ব দেন। এ সময়ে সারা বিশ্বজুড়ে এ প্রক্রিয়াতেই ‘কমিউনিজম মৃত’- সাম্রাজ্যবাদীদের এ অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে ওঠে। বিশ্বব্যাপী কমিউনিজমের ঝান্ডাকে তুলে ধরা ও প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী (তৎকালে মাওচিন্তাধারানুসারী) অগ্রসর পার্টিসমূহের নেতৃত্বে ১৯৮৪ সালে চতুর্থ আন্তর্জাতিকের ভ্রুণকেন্দ্র হিসেবে বিপ্লবী আন্তর্জাতিকতাবাদী আন্দোলন(আর.আই.এম. বা রিম) গড়ে ওঠে। এভাবে আর.আই.এম-এর পরিচালনায় দেশে দেশে পার্টি গঠন ও বিপ্লবী সংগ্রাম এগিয়ে চলে। রিম-বহির্ভূত মাওবাদী বিপ্লবী পার্টিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রেও রিম বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে থাকে। রিমের নেতৃত্বে ও তার বহির্ভূত মাওবাদীদের পরিচালনায় পেরু-নেপাল এবং ভারতের গণযুদ্ধ চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে আনতে না পারলেও বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত জাতি ও জনগণের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে নতুন বিপ্লবী দিশা প্রদান করে ও উদ্দীপণা সৃষ্টি করে।
কয়েক দশকে আরআইএম ৩য় আন্তর্জাতিকের পর নতুন আন্তর্জাতিক গড়ে তোলা কেন সঠিক, আন্তর্জাতিক কিভাবে পরিচালিত হবে, তার অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানে সাংগঠনিক নীতিমালার আবশ্যিকতা, আন্তর্জাতিক সাধারণ লাইনের বিকাশ, মাওবাদীদের ঐক্য ও পার্থক্যসমূহ সমাধানের পদ্ধতিশাস্ত্র সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করে। যা কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সর্বোচ্চ যৌথ অর্জন। বর্তমান কমিউনিস্ট পার্টি গঠনকে তার আলোকেই দেখতে হবে। তার ইতিবাচক অর্জনসমূহকে ভিত্তি করে তার ত্রুটি/বিচ্যুতি ও ভুলগুলোকে সংশোধন করতে হবে। সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে হবে।
এক্ষেত্রে রিম গঠন ও তার সাথে যুক্ত থেকে কমরেড আনোয়ার কবীরের নেতৃত্বে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে। কমরেড মোস্তাকের সাম্যবাদী দলসহ আরও কিছু ব্যক্তি ও শক্তি/সংগঠনও রিম-এর সাথে যুক্ত থেকে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছেন।
কমরেড মোফাখ্খার চৌধুরীর পূবাকপা(এম.এল) এবং কমরেড রাকেশ কামালের পূবাকপা(এম.এল)(লাল পতাকা) রিমে যোগ না দিলেও মাওবাদের পতাকাকে সমুন্নত রেখে এগিয়ে চলার পথে জীবন উৎসর্গ করেছেন।
উপরোক্ত আলোচনা হচ্ছে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন ও তার সাধারণ লাইনের এক স্তর থেকে আরেক নতুন উচ্চস্তরে উন্নীত হওয়া এবং কমিউনিস্ট আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টিকে নতুনভাবে পুনর্গঠনের ধারাবাহিক বিকাশের প্রক্রিয়ার একটি সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনা।
এই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতাকে বজায় রেখে এবং এর তত্ত্বগত ও মতাদর্শগত অবস্থানগুলোকে ভিত্তি করে কমিউনিস্ট আন্দোলন, কমিউনিস্ট ও কমিউনিস্ট পার্টিকে সারসংকলন করতে হবে। এটাই মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ-এর দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্ত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি। এটাই শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবের বৈজ্ঞানিক মেথডলজি। এছাড়া বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে সমালোচনা ও লাইনের গ্রহণ বর্জন হবে স্বতস্ফুর্ত, লক্ষ্যবিহীন, দিশাহীন। যা শুধু কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রক্রিয়ার বাইরে থেকে বিভ্রান্তিই ছড়াবে ও তাকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে।
শ্রমিক শ্রেণীর শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি সম্পর্কে :
জনাব আবির হাসান পুস্তিকার ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন ‘এটি গ্রন্থ হলে’ এম.আর চৌধুরীকে উৎসর্গ করতেন। কারন তিনি “এ অঞ্চলের জীবিত ও মৃত সকলের মধ্যে শ্রমিক শ্রেণীর শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি” মনে করেন এম.আর.চৌধুরীকে। কিভাবে? তিনি বলেছেন- এম.আর.চৌধুরী বই লিখেছেন, কেউ তার খন্ডন করেননি; তাই তার লাইন, দৃষ্টিভঙ্গি অগ্রসর। আমরা বলবো তার বইয়ে পূর্বোক্ত কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দ্বান্দ্বিক, ধারাবাহিক ঐতিহাসিক লাইনগত সারসংকলন নেই। নেই সে অনুযায়ী করণীয়। ফলে এটা পড়ে প্রকৃত বিপ্লবী কমিউনিস্টদের পক্ষে কোন কাজেই লাগানো যাবে না। শুধু স্বতস্ফুর্ত, গোড়ামীবাদী, ঘরোয়া তত্ত্বচর্চার সমালোচনা ও খন্ডন ব্যতীত। বৃটিশ-ভারতের পর পাকিস্তান পর্বে উপমহাদেশে শহীদ কমরেড চারু মজুমদার, সিরাজ সিকদার, মনিরুজ্জামান তারা এবং বর্তমান সময়ে ভারতে আজাদ, কিষেনজি ও এদেশে মোফাখ্খার চৌধুরী, রাকেশ কামাল; আর এখনো ভারত-বাংলাদেশে মাওবাদী কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন কমরেড গণপতি এবং কমরেড আনোয়ার কবীরসহ দক্ষিণ এশিয়ার আরও কিছু নেতৃত্ব। তারা বহু দশক ধরে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ-এর মানদন্ড অনুযায়ী কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলেছেন, বিপ্লবী সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন এবং অব্যাহত সারসংকলনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছেন। তাদের ও তাদের পার্টি সম্পর্কে এড়িয়ে, অজ্ঞ থেকে বা কিছুই গ্রহণ না করে, কোন মানদন্ডে তিনি এম.আর.চৌধুরীকে শ্রমিক শ্রেণীর শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধির স্থান দিলেন?
জনাব আবির হাসান অভিযোগ করেছেন জনগণ কি, কমিউনিস্ট কি ইত্যাদি প্রশ্নে উত্তর না দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির দোকান খুলেছে বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষে। আমরা প্রথমোক্ত লাইনগত ইতিহাস অংশে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন সম্পর্কে উল্লেখ করেছি। এক্ষেত্রে আবারও পরিষ্কার করছি যে, ভারতে কমরেড চারু মজুমদার তৎকালীন সংশোধনবাদবিরোধী বিখ্যাত ৮-দলিল রচনা করে অতীতের সাথে রাপচার ঘটিয়ে নতুন কমিউনিস্ট পার্টির করণীয় তুলে ধরেছিলেন এবং এর পরপরই আমাদের দেশে কমরেড সিরাজ সিকদার পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের থিসিস রচনা এবং অন্যান্য ধারার সাথে সংগ্রামের দলিল রচনা করে কমিউনিস্ট কি, জনগণ কি এবং মার্কসবাদ ও সংশোধনবাদের মধ্যে পার্থক্য কোথায়, কিভাবে- তা পরিষ্কারভাবে নির্ধারণ করেন এবং এ প্রক্রিয়ায় পার্টি গড়ে তোলেন, বিপ্লবী সংগ্রাম জাগরিত করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ভারতে আজকের কমরেড গণপতির নেতৃত্বাধীন সিপিআই(মাওবাদী)সহ অন্যান্য মাওবাদী কেন্দ্র এবং আমাদের দেশে কমরেড আনোয়ার কবীরের নেতৃত্বাধীন পূবাসপাসহ অন্যান্য মাওবাদী শক্তি।
এম.আর.চৌধুরী তো এই আঁকাবাঁকা, ঝড়ো, রক্তাক্ত এবং খুবই গভীর ও গুরুতর তত্ত্বগত রাজনৈতিক সংগ্রামকারী বিপ্লবী কমিউনিস্ট শিবিরেই ছিলেন না। তিনি কোনদিন কোন বিপ্লবী অনুশীলনে জড়িত হননি, আজও না। অনুশীলন যা করেছেন তা হলো সত্তর দশকের ট্রেড ইউনিয়নবাদী, সংস্কারবাদী-অর্থনীতিবাদী আন্দোলন। এর পর থেকে আজ পর্যন্ত শুধু পুরনো মার্কসীয় সাহিত্য অধ্যয়ন করছেন এবং এই বিমূর্ত তত্ত্ব চর্চা দিয়ে বর্তমান কমিউনিস্ট আন্দোলনকে দেখছেন এবং এই গন্ডীর মধ্যে থেকে জীবনপাত করছেন। আর বাস্তব অনুশীলনে নিয়োজিত বিপ্লবী ও আধুনিক সংশোধনবাদীদের একাকার করে ভুল-ত্রুটি ধরার জন্য কলম নিয়ে বসে রয়েছেন। বিপ্লবী অনুশীলনের বাইরে থেকে শুধু বিপ্লবীদের ভুল-ত্রুটি খোঁজা মার্কসবাদীদের কাজ নয়, কমিউনিস্টদের কাজ নয়। এটা বিপ্লবের উপকার করে না। বরং অবাস্তব, বিমূর্ত, বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত উদ্ধৃতি আউড়ে কমিউনিস্ট, বিপ্লবী ও কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে বিভ্রান্তির জন্ম দেয়। যা বিপ্লব আকাঙ্খী নবীন ছাত্র-বুদ্ধিজীবী ও বিপ্লব ফেরত ব্যক্তিগত হতাশাগ্রস্থদের পার্টি বিহীন, বিপ্লবী সংগ্রাম বিহীন ‘নিরাপদ ব্যক্তি কমিউনিস্ট’ থাকার নসিহত করে সুবিধাবাদকে ন্যায্য করে।
মার্কসবাদ শিক্ষা দেয় শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবের বিজ্ঞানকে ধারণ করতে হলে তার যুগোপযোগী মতবাদের বিকাশকে গ্রহণ করতে হবে এবং সে অনুযায়ী বিশ্ব সর্বহারা বিপ্লব ও তার অংশ হিসেবে নিজ দেশে পার্টি গঠনের মধ্য দিয়ে বিপ্লব সাধন করতে হবে। এছাড়া কেউ ঘরে বসে বই পড়ে এবং বই থেকে বই লিখে বিপ্লবী থাকতে পারেন না, কমিউনিস্ট তো আরও দূরের বিষয়। মোটাদাগে এ জাতীয় বুদ্ধিজীবীদের সমাজতন্ত্রের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হয়তো বলা যেতে পারে। এটা এক পায়ে দাঁড়িয়ে সবগাছ ছাড়িয়ে আকাশে উঁকি মারতে পারবে না। মাও যেমন বলেছেন- ‘নাসপাতির স্বাদ জানতে হলে নাসপাতি খেতে হবে, তেমনি বিপ্লব করতে হলে বিপ্লবী অনুশীলনে যুক্ত হতে হবে।’
কমিউনিস্ট পার্টি গঠন প্রসঙ্গে :
তারা মনে করেন আগে একটি বিশুদ্ধ (যদিও তার যুগোপযোগী মতবাদিক-তত্ত্বগত মানদন্ড নেই) কমিউনিস্ট পার্টি বানাতে হবে, তারপর অনুশীলনে যেতে হবে। এভাবে কেউ করছেন না এবং নিজেরাও তারা পারছেন না। ফলে নিজেদের লেজ কাটা পড়ায় এখন অন্যদের লেজটাও কাটানোর ছবক দিয়েছেন। বিগত চার দশক ধরে এ জাতীয় ঘরোয়া তত্ত্বচর্চাই এর জীবন্ত উদাহরণ। তাই, শ্রমিক শ্রেণীর বর্তমান যুগের সর্বাধুনিক বিপ্লবী তত্ত্ব মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ-এ সজ্জিত গণযুদ্ধের অনুশীলনরত গোপন এবং শ্রেণীচ্যুত বিপ্লবীদেরও আহ্বান করেছেন বাড়ী ফিরে এসে প্রকাশ্যে আইনী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন করে শ্রমিক শ্রেণীকে শিক্ষিত করে পরিস্থিতিকে পাকিয়ে তারপর বিপ্লব করার জন্য। কমিউনিস্ট পার্টি, বিপ্লব ও গণযুদ্ধ সম্পর্কে কত বিশাল অজ্ঞতা থাকলেই না কেবল এমন আহাম্মকী আকাঙ্খা পোষণ করা যায়।
কমিউনিস্ট পার্টি বলতে তিনি বুঝিয়েছেন মার্কস, এঙ্গেলস এবং লেনিন প্রদর্শিত পার্টি কাঠামো। ঝাপসাভাবে কিছুটা মাওকে আনতে চেষ্টা করলেও মার্কস-এঙ্গেলসের যুগের কমিউনিস্ট পার্টির ধারণা এবং এর বিকাশ সাধন করে লেনিন-স্ট্যালিনের কমিউনিস্ট পার্টি এবং সর্বশেষ মাওসেতুঙের কমিউনিস্ট পার্টির গঠন যে একস্তর থেকে আরেক নতুন উচ্চতর স্তরে বিকশিত হয়েছে তা বুঝতে চাননি। আবার সর্বশেষ বিকশিত অবস্থান থেকেই যে পার্টি গঠন করতে হবে সে উপলব্ধিও নেই। ফলে তা মার্কসবাদী জ্ঞানতত্ত্ব ও মেথডলজি থেকে বিচ্যুত হয়েছে। এবং সমাজতন্ত্র, কমিউনিজম ও কমিউনিস্ট পার্টি প্রশ্নে সমাজবিকাশের সাথে সাথে মতবাদ বিকাশের এবং তার অধীনে পার্টি, রণনীতি-রণকৌশল, সংগঠন- সংগ্রামের পথ-পদ্ধতির পরিবর্তন ও বিকাশের প্রক্রিয়াকে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে।
তিনি দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে দেখতে পারেননি, দেখেছেন একাডেমিক গবেষণার দৃষ্টিভঙ্গিতে। বস্তুত তা স্বতস্ফুর্ত, অদ্বান্দ্বিক, অনৈতিহাসিক, অবাস্তব এবং এ যুগে প্লেটোনিক-ইউটোপীয় চিন্তাধারার প্রতিফলন। এটা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ বিরোধী নির্জলা সংশোধনবাদ।
কমিউনিস্ট আন্দোলন, সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বিভ্রান্তি :
৩০ পৃষ্ঠার এ পুস্তিকায় বামপন্থীদের ভুল/ত্রুটিকে সমালোচনা ও মূল্যায়ন করতে গিয়ে কমিউনিস্ট, কমিউনিস্ট পার্টি ও সমাজন্ত্রকেই লেখক নেতিকরণ করে ফেলেছেন। এমনভাবে পুস্তিকার নামকরণ করেছেন যেন কমিউনিস্ট পার্টি এবং বিপ্লবই তাচ্ছিলের বিষয়। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দেখিয়েছেন রাশিয়ায় এবং চীনে সমাজতন্ত্র হয়েছিল না। যেন রুশ-চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের চেয়েও পার্টি বিহীন, সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ববিহীন প্যারী কমিউন অগ্রসর। এভাবে তিনি প্যারী কমিউনের উপর মার্কস-এঙ্গেলসের সারসংকলনের বিপরীতে সমাজতন্ত্রের ধারণাকে প্রতিস্থাপিত করেছেন।
উপরোক্ত পয়েন্টগুলো ছাড়াও আরও কিছু পয়েন্ট আছে যেগুলোতে আলোচনা করা যায়। কিন্তু অপরিহার্য নয়, তাই এ পুস্তিকা সম্পর্কে আলোচনা আর দীর্ঘায়িত না করে সমাপ্ত করছি। একইসাথে মাওবাদী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে নিয়োজিত আন্তরিক কর্মী-সমর্থকদের প্রতি আহ্বান রাখছি- এ জাতীয় বিলোপবাদী, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী, বিপ্লবী অনুশীলন বিরোধী লাইন ও মতাদর্শকে অব্যাহতভাবে সক্রিয়তার সাথে উন্মোচন করে, খন্ডন করে নিজেদের মতাদর্শকে শাণিত করে চলমান দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিপ্লবী সংগ্রামকে শক্তিশালী করার জন্য।
– জুলাই, প্রথম সপ্তাহ, ২০১২
Red salute
ধন্যবাদ।